বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত, ভোপাল: ‘হামে না জান লেনে ওয়ালে কো সাজা দেতে হ্যায়! না জান বাঁচানে ওয়ালো কো শাবাশি!’
জঙ্গল ও আগাছার মাঝ থেকে উঁকি মারা রংচটা অভিশপ্ত চিমনিটার দিকে তাকাতেই মনে পড়ল ‘দ্য রেলওয়ে মেন’-এর আক্ষেপ ভরা অমোঘ সংলাপ। ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার (Bhopal Gas Tragedy) উপর তৈরি চার এপিসোডের ওয়েব সিরিজ নেটফ্লিক্সে শুরু হতে চলেছে চলতি নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। ১৯৮৪-র ডিসেম্বর থেকে আজ ২০২৩-এর নভেম্বর। দীর্ঘ ৪০ বছর পরেও বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাসের অভিশাপ থেকে নিষ্কৃতি মেলেনি নরেলার। ভোপাল শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে এই জনপদে আজও সুস্থ শিশুর জন্ম অবিশ্বাস্য ঘটনাই!
বিশ্বাস হারিয়েছে ভয়ংকর সেই গ্যাস দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের স্বপ্নও। ফি বছর ভোট এলেই রাজনীতির কারবারিদের রংচঙে সাজানো জিপ ঢোকে এলাকায়। প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটে নিয়ম করে। তারপর ভোট চলে যায়। জিপ চাপা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যাবতীয় প্রতিশ্রুতিও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
সে সবে অবশ্য কিছুই যায়-আসে না নরেলাবাসীর। দু’বেলা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মাঝে তাঁদের স্বপ্ন দেখার ফুরসত কোথায়? ভোটের উত্তাপ তাই তাঁদের ছুঁতে পারে না। ‘চুনাও’ শব্দটাতে কোনও হেলদোল নেই ষাটোর্ধ্ব শেখ নিজামুদ্দিন, ফিরদৌসি আহমেদ বা রাজাবাবু গিট্টাদের। ওঁরা জেনে গিয়েছেন, স্রেফ ‘ভোটব্যাঙ্ক’ ছাড়া নরেলাবাসীর কোনও দাম নেই রাজনৈতিক দলের কাছে।
[আরও পড়ুন: ফুল নেই, শুধুই কাগজ! আজব পুষ্পস্তবক উপহার প্রিয়াঙ্কাকে, ভাইরাল মধ্যপ্রদেশের ভিডিও]
১৯৮৪-র ২ ডিসেম্বর রাতে ইন্ডিয়ান কারবাইড কারখানার বিষাক্ত গ্যাস লিকের ঘটনায় কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল নরেলা। গোটা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যম পরদিন এখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। সরকারি হিসাবে হাজার তিনেক হলেও স্থানীয়দের দাবি, মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ হাজারেরও বেশি। সারাজীবনের জন্য অসুস্থ বা পঙ্গু হয়েছিলেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ। সে সব দিন অবশ্য পেরিয়ে এসে নরেলা আজ আর ছোট জনপদ নেই। ভোপাল শহর গ্রাস করেছে তাকে। একসময়ের ছোট্ট জনপদ আজ শহুরে কংক্রিটের জঙ্গলে।
চল্লিশ বছর আগের ভয়ংকর গ্যাস দুর্ঘটনার গল্প শুনেছি অন্যের মুুখে। এবার ভোটমুখী মধ্যপ্রদেশে (Madhya Pradesh) পা রাখতেই ঠিক করেছিলাম, একবার নিজের চোখে নরেলা-কে দেখে আসাই যাক! সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম নরেলার উদ্দেশে। চাপা উত্তেজনা ছিল। নবাবি আমলের পুরনো ভোপালকে পেরিয়ে নরেলা ঢোকার মুখে প্রথম ধাক্কা! বাজারের উপর দিয়ে যাওয়া ফ্লাইওভারে উঠতেই সহযাত্রী দেখালেন কারখানার একটি চিমনি। জানালেন, এই সেই অভিশপ্ত চিমনি। যেখান থেকে ৪০ বছর আগে মধ্যরাতে বেরিয়ে আসা প্রাণঘাতী গ্যাস কেড়ে নিয়েছিল কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ। সারা জীবনের জন্য বিকলাঙ্গ করে দিয়েছিল আরও কয়েক হাজার মানুষকে।
[আরও পড়ুন: নীরব-মেহুলদের ১৫ লক্ষ কোটির ঋণ মাফ! জনতার আমানত ‘নয়ছয়’ নিয়ে নির্মলাকে তোপ জহরের]
গাড়ি থামল কারখানার গেট থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে। আগাছার জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে হেঁটে মূল প্রবেশদ্বার। কিন্তু গেটে মস্ত তালা! ভিতর ঘুরে দেখার আশা জলে। বাইরে থেকেই ঠাওর হল এখানে নিয়মিত মানুষের যাতায়াত রয়েছে। স্থানীয় নারিয়েল খেড়া এলাকার বাসিন্দা রাজেশ মানকার কথায়, ‘‘আমরা এলাকার মানুষ কারখানার ধারেকাছেও ঘেঁষি না। কিছু খারাপ মানুষ আসে এখানে রাতের আঁধারে।’’ রাজেশের কথায়, নজরদারির অভাবে প্রতিদিনই কারখানার যন্ত্রপাতি, মায় লোহার জানালা-দরজাও চুরি হয়ে যাচ্ছে। নরেলার বাসিন্দা ও দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল রহিম জানাচ্ছেন, ‘‘কারখানার দিকে তাকালেই সেই দিনের কথা মনে পড়ে যায়। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে যায় আজও। তাই এই পরিত্যক্ত কারখানা আমরা সবাই এড়িয়ে চলি।’’ ভোটের কথা উঠতেই ঝাঁজিয়ে উঠে রহিম জানান, ‘‘আমরা বারবার রাজনীতির শিকার। তাই ভোট নিয়ে কোনও উৎসাহ নেই। ভোটের দিন বুথে যেতে হয়, তাই যাই। ব্যস! শুধু চোখের সামনে স্বজন হারাতে দেখেছি।’’
[আরও পড়ুন: তদন্তে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতির বিরুদ্ধে, রিপোর্ট চাইল সুপ্রিম কোর্ট]
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জে পি নগর, আর এস নগরের মানুষেরও একই অভিজ্ঞতা। হতদরিদ্র এই মানুষগুলিই বর্তমান বিজেপি বিধায়ক ও রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী বিশ্বাস সরঙের তুরুপের তাস। ২০০৮ থেকে এখানকার বিধায়ক তিনি। অর্থের জোরে মানুষগুলিকে কার্যত কিনে রেখেছেন বলে বিরোধীদের প্রচার। তাঁকে হারাতে কংগ্রেস প্রার্থী করেছে ধনকুবের মনোজ শুক্লাকে। বিশ্বাস সরঙের দাবি, ‘‘সারা বছর ২৪ ঘণ্টা এঁদের জন্য আমার বাড়ির দরজা খোলা থাকে। তাই তাঁরা আমাকে ছাড়া কাউকে ভাবতেই পারেন না।’’ অন্যদিকে কংগ্রেস প্রার্থীর দাবি, এবার পাশা উল্টোবে। কারণ মানুষ এঁদের চিনে গিয়েছে।