বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: পুরভোটের আগে এমন চ্যালেঞ্জ নেওয়া কিছুটা নজিরবিহীনই বটে। সৎ ব্যক্তির হাতে থাকবে পুরসভা নাকি পুরসভার দখল নেবে লুটেরারা, জনসাধারণের কাছে এমন প্রশ্ন তুলে দিয়ে নদিয়ার তাহেরপুর পুরসভার পুরভোটে মানুষের কাছে বামপন্থী কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কেউ আনতে পারেন কিনা, সেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল দলীয় নেতৃবৃন্দ। যা এবারের পুরভোটে বামপন্থীদের সাফল্যের আরও একটি হাতিয়ার। আবাস যোজনার টাকা-সহ একাধিক দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগ অন্য পুরসভার বিরুদ্ধে তুলেছিলেন বামপন্থীরা। তারাই আবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেই তুলনায় বামফ্রন্ট পরিচালিত তাহেরপুর পুরসভার বিগত বোর্ডের বামপন্থী কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে একটি পয়সাও চুরির অভিযোগ কেউ করতে পারবেন কি? পুরভোটের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে জনসাধারণের কাছে সরাসরি প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল বামফ্রন্ট।
ভোটের প্রচারে বামফ্রন্টের নেতারা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ, আবাস যোজনার যত ঘর হয়েছে, সেই ঘর তৈরির ক্ষেত্রে একটি পয়সাও কাটমানি হিসাবে কোন কাউন্সিলর নিয়েছেন কিনা,প্রমাণ করুন। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল, আবাস বন্টনে একটি টাকাও কোন বামপন্থী কাউন্সিলর ঘুষ নিয়েছেন কি? তাহেরপুরের বামপন্থী নেতারা কি ঠিকাদারি, প্রোমোটারি, সাট্টা, জুয়া বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত? প্রমাণ করুন। গত কয়েকবছরে তাহেরপুর পুর এলাকায় বাংলা আবাস যোজনায় প্রায় ৪ হাজার গরিব মানুষ ঘর পেয়েছেন। সেই ঘর প্রাপকদের কাছ থেকে বামপন্থী কাউন্সিলররা এক কাপ চা খেয়েছেন কিনা, ইট, বালি, সিমেন্ট, লোহার রড নির্দিষ্ট কোন জায়গা থেকে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন কিনা, ভোটের আগে জনসাধারণের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বামফ্রন্ট নেতারা।
[আরও পড়ুন: খুন নাকি ভিলেন চিংড়িই? খাস কলকাতায় রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়েই তরুণীর আচমকা মৃত্যুতে বাড়ছে রহস্য]
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোটারদের কাছে নিজেদের কাউন্সিলরদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার সাহসিকতা কিছুটা নজিরবিহীন। যা ভোটারদের মনে প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া, পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরসভার খরচ বাঁচানোর উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন বিদায়ী বোর্ডের চেয়ারম্যান রতন রঞ্জন রায়। পুরসভার নিজস্ব স্করপিও গাড়ি থাকা সত্ত্বেও পুরসভাতে আসা যাওয়া এবং কাছেপিঠে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রতন রঞ্জন রায় নিজের স্কুটিতে করেই যাতায়াত করতেন। পুরসভার থেকে এক পয়সাও নিতেন না। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া স্করপিও ব্যবহার করা হত না।
এছাড়া, বিগত কয়েক বছরে পুরসভার বোর্ড মিটিংগুলিতে টিফিন বাবদ খরচ একেবারেই কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সামান্য চা, বিস্কুট বা ন্যূনতম একটু টিফিনের উপর দিয়ে বোর্ড মিটিং চালিয়ে নেওয়া হত।এমনকি, ‘দুয়ারে সরকারে’র মতো প্রকল্পগুলিতে পুরসভার কর্মীদেরও খুবই কম খরচের মধ্যে দিয়ে চলতে হত। আর সেই কারণে রতন রঞ্জন রায়কে অনেকেই ‘কিপটে’ বলতেন। তুলনামূলকভাবে পুরনাগরিকদের উপর চাপানো পুরকরের পরিমাণ অন্য পুরসভা থেকে অনেকটাই কম। যদিও উন্নয়নের বিচারে তাহেরপুর পুরসভা জেলার অন্য পুরসভা থেকে অনেক বেশি কাজ করতে পেরেছে, তা কিন্তু নয়।
কারণ, তাহেরপুর শহরের অধিকাংশ রাস্তার অবস্থাই খারাপ। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য বিগত বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বক্তব্য ও অভিযোগ, রাজ্য সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ। একাধিক রাস্তার প্রজেক্ট করে পাঠানো সত্বেও তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি, কোনও প্রজেক্টের কাজ করার আদেশ দেওয়ার পরে সেই প্রজেক্টর টাকা দেওয়া হয়নি। তাহেরপুরের প্রচুর মানুষ ভিন রাজ্যে কাজ করেন। করোনাকালে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে তাঁরা যখন শহরে ফিরে এসেছেন, তখন ২টি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার তৈরি করে সুষ্ঠু পরিষেবা দেওয়ার পরেও খরচ বাবদ টাকা রাজ্য সরকার দেয়নি বলে অভিযোগ।
এই বিষয়ে সিপিএমের তাহেরপুরের এরিয়া কমিটির সম্পাদক সুপ্রতীপ রায় অভিযোগ করেছেন, তাহেরপুরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উন্নয়ন, একটি কলেজ তৈরি-সহ বেশ কয়েকটি প্রতিশ্রুতি গত পুরভোটে তৃণমূল কংগ্রেস দিয়েছিল। সেগুলির একটিও পূরণ হয়নি। তাহেরপুরে যে রিহ্যাবিলিটেশন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন (আর আই সি)-র জায়গা পড়ে রয়েছে, সেই জায়গায় কর্মসংস্থানভিত্তিক শিল্পস্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকার। মানুষ সে সব দেখেছেন, মনে রেখেছেন।
যদিও এ বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ও জেলা পরিষদের মেন্টর বাণীকুমার রায় বলেন, “যেকোনও প্রজেক্ট পাঠিয়ে দিলেই হয় না। সেটা ভায়াবল কী না, তা দেখার বিষয় রয়েছে। সব কিছুই একটা সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়। তাছাড়া কোনও কাউন্সিলর টাকা নিয়েছেন কিনা, তা কি ওইভাবে প্রকাশ্যে আসে?” যদিও বানীকুমার রায় আরও জানান, “তাহেরপুরে আমাদের কিছু ভুল ত্রুটি রয়েছে। কী কী ভুল ত্রুটি রয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে দলে পর্যালোচনা করা হবে।”