এ-দেশের ঘরপোড়ারা নতুন সংকেত পেতে শুরু করেছে। হিমন্ত বিশ্বশর্মা অসমের মুখ্যমন্ত্রী হয়েই বলেছেন, মুসলমানদের পরিবার পরিকল্পনায় সচেতন হতে হবে। যোগী আদিত্যনাথকেও দেখা গেল ঢাকঢোল পিটিয়ে জননিয়ন্ত্রণ বিলের খসড়া প্রকাশ করতে। জন্মনিয়ন্ত্রণ অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু তার নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য নেই তো? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঠিক একমাস আগে এই স্তম্ভে মোদি-যোগী দ্বৈরথ নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখেছিলাম- হিন্দুত্বের এই দুই ‘ম্যাসকট’-এর লড়াই আদতে ‘পলিটিকাল পারসেপশন’-এর দ্বন্দ্ব। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের ধারণা, তাঁর সংজ্ঞায়িত হিন্দুত্বে ভর দিয়ে নিজের জোরে আগামী বছরের ভোট-বৈতরণি অনায়াসে পেরিয়ে যাবেন। নরেন্দ্র মোদি আবার মনে করেন, যোগীর রাশ টানতে না পারলে বিপদ। উত্তরপ্রদেশ (Uttar Pradesh) হাতছাড়া হলে বাকি ভারতও চোখ ফেরাবে। লিখেছিলাম, মোদি ও যোগী দু’জনেই খেলাটা তাঁদের মতো করে খেলবেন। সাম্প্রদায়িকতা-ই তাঁদের আস্তিনে লুকনো একমাত্র তুরুপের তাস, যা সময়মতো তাঁরা ব্যবহার করবেন।
সেই নিবন্ধে একটা জিজ্ঞাসা ছিল, ইতিমধ্যেই একটু একটু করে সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজতলা তৈরি হচ্ছে কি? সাম্প্রদায়িকতার জলঘোলা করার মতো কিছু কিছু ঘটনা যেন সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেসব ঘটনার একটা ছিল গোরক্ষপুর ধামের আশপাশের মুসলমানদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার তাগিদ। অজুহাত নিরাপত্তার। দ্বিতীয় উদাহরণ, আদালতের নির্দেশে বরাবাঁকি জেলার একশো বছরের পুরনো মসজিদ ভেঙে দেওয়া। তৃতীয় উদাহরণ, লাক্ষাদ্বীপ। মুসলমান অধ্যুষিত অশান্তি-বর্জিত এই দ্বীপমালাকে পর্যটনের স্বার্থে ঘেঁটে দেওয়া হচ্ছে। অনিদ্রা ও ত্রাস এখন সেখানকার শান্তিপ্রিয় জনতার নিত্যসঙ্গী। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ‘মিঞা-বর্জিত রাজনীতি’ ছিল চতুর্থ উদাহরণ। একজন মুখ্যমন্ত্রী বিন্দুমাত্র রাখঢাক না রেখে বলছেন, তাঁর মিঞা-ভোট দরকার নেই। মিঞা-বিরোধী রাজনীতি না করলে অসমে কল্কে পাওয়া কঠিন! এই দেশে এমন কথা বুক ফুলিয়ে আর কোনও রাজনৈতিক নেতা বলেছেন বলে মনে করতে পারছি না। অথচ, শাস্তির বদলে হিমন্ত পাচ্ছেন ফুলমালা! পিঠ চাপড়ানি! এসব ইঙ্গিত থেকে যে নকশাটা উঠে আসে, তা সেই আগমার্কা বিভাজনী রাজনীতির। একমাসও কাটেনি, ছবিটা এখন আরও স্পষ্ট। বেশ বোঝা যাচ্ছে, এই রাস্তায় হাঁটা ছাড়া মোদি-যোগীর উপায় নেই।
[আরও পড়ুন: সিপিএময়ের দুঃসময়, বাংলায় কেন ভরাডুবি বামেদের?]
কী আশ্চর্য, একমাস কাটতে না কাটতেই দেশের ৭৪ জন প্রাক্তন আমলা ও পুলিশকর্তা এক খোলা চিঠিতে উত্তরপ্রদেশের সার্বিক অরাজকতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুললেন! সেই চিঠিকে সমর্থন জানিয়ে সই করেছেন আরও অন্তত দুশোজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা সবাই রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আদিত্যনাথের পুলিশ যে ভয় ও ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে, যেভাবে হত্যা করছে বিচারাধীন বন্দিদের, নির্বিচারে বন্দি করছে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের, লাভ জিহাদের নামে ও গো-হত্যার ধুয়া তুলে মুসলমানদের জীবন তটস্থ করে তুলেছে, সব ধরনের কালা কানুনের সদ্ব্যবহার করছে- তাতে ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁরা বলেছেন, রাজ্যে আইনের শাসন বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যা চলছে, তা ভয়ের রাজত্ব, ‘জঙ্গলরাজ’।
এই চিঠি ও পঞ্চায়েতের ব্লক-প্রধানদের নির্বাচনে জেলায় জেলায় বিজেপি নেতা ও পুলিশের মারকাটারি ভূমিকার কথা মিডিয়ার কল্যাণে একই সঙ্গে জানাজানি হয়। সরকার না অভিযোগকারী- কারা সত্যি, তা আর জবরদস্তি ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। যোগীরাজ্যে ঠিক কী চলছে এবং আগামী দিনে এইসব ঘটনাপ্রবাহ কোন খাতে বইবে, তা আন্দাজ করার মধ্য দিয়েই একমাস আগে লেখা সেই ‘বীজতলা তৈরি’-র বিষয়টা স্পষ্ট হচ্ছে। ঘরপোড়ারাই সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়। এ-দেশের ঘরপোড়ারা নতুন সংকেত পেতে শুরু করেছে। সংকেত ধেয়ে আসছে চারদিক থেকে। শুরুটা সেই হিমন্ত-ই করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েই বলেছেন, মুসলমানদের পরিবার পরিকল্পনায় সচেতন হতে হবে। একপক্ষকালের মধ্যেই তাঁর জোড়া ঘোষণা- আদিবাসী ও দেশজ মানুষদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যরক্ষায় রাজ্যে একটা আলাদা মন্ত্রক গড়ে তোলা হবে এবং হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন এলাকা ও কোনও মন্দিরের পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে গোমাংস বেচাকেনা চলবে না। এ নিয়ে বিধানসভায় বিলও এসেছে।
মিঞাদের ‘সবক’ শেখানোর কথা যিনি বারবার শোনান, আদিবাসী ও দেশজ বলতে তিনি কাদের বোঝেন, সেই ব্যাখ্যার বিশদ প্রয়োজন নেই। পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের দরুন রাজ্যে আদৌ কোথাও গরুর মাংস বিক্রি করা যাবে কি না, সন্দেহ। মিঞা-বিরোধী নির্ঘোষের ঢেউ ব্রহ্মপুত্রবাহিত হয়ে গোমতীতে ঢেউ তুলেছে কি না কে জানে! আদিত্যনাথকেও দেখা গেল ঢাকঢোল পিটিয়ে জননিয়ন্ত্রণ বিলের খসড়া প্রকাশ করতে। এক দল। এক ভাবাদর্শ। এক লক্ষ্য। দুই মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছেও তাই অভিন্ন, জন্মনিয়ন্ত্রণে সরকারি চাকরি ও সরকারি প্রকল্পের সুবিধা এবং পুর পঞ্চায়েত ভোটের প্রতিনিধিত্বে রাশ টানা। অথচ, জবরদস্তি কিছু না করে সারা দেশেই প্রজনন হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা জানাচ্ছে, গত পনেরো বছরে অসমে মুসলমানদের প্রজনন হার কমেছে ১.২ শতাংশ, হিন্দুদের ০.৪ শতাংশ। উত্তরপ্রদেশে গত ১৭ বছরে কমেছে ১.৯ শতাংশ। যোগী চান, ২০২৬-এর মধ্যে প্রজনন হার ২.৭ থেকে ২.১ শতাংশে নামাতে এবং ২০৩০-এর মধ্যে ১.৯ শতাংশে নিয়ে আসতে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ অবশ্যই প্রয়োজনীয়। সেজন্য বহুবিধ কর্মসূচিও নেওয়া দরকার। সমীক্ষা বলছে, সর্বত্র শিক্ষিত মেয়েদের প্রজননের হার অশিক্ষিতদের চেয়ে কম। মুসলমানদের মধ্যে এই হার কমছে হিন্দুদের তুলনায় বেশি। আবার, দলিত ও আদিবাসীদের মধ্যে প্রজনন হার অন্য হিন্দুদের তুলনায় বেশি। বিষয়টি সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরিখে দেখা দরকার, ধর্মের আলোয় নয়। কিন্তু চোরা কবেই বা ধর্মের কাহিনি শোনে? ফলে দেখা গেল, খসড়া নীতিতে উৎসাহী জনতা উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে মিছিল বের করল। লক্ষ্য কারা, সহজেই অনুমেয়। রাজনৈতিক ঘূর্ণি এভাবেই তৈরি হয়। সেই ঘূর্ণি দাবানল সৃষ্টি করে। ধর্মীয় মেরুকরণই তো সিঁদুরে মেঘ!
একটার পর একটা ঘটনাও ঘটছে যেগুলো সেই মেরুকরণের সলতে পাকানো বলে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আর্যাবর্তের দাঙ্গার ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি এই খাতেই বয়ে চলেছে। লখনউয়ের দুই মুসলমান বাসিন্দাকে পুলিশ সেদিন গ্রেপ্তার করল। তারা নাকি আল কায়দা জঙ্গি! স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ওই সংগঠন নাকি বিভিন্ন জায়গায় নাশকতার ছক কষেছে। ইউএপিএ-র মতো দমনমূলক আইনে বিনা বিচারে বন্দিদের মধ্যে দোষী সাব্যস্তের শতাংশের হার লক্ষ করলে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অদক্ষতা ও অভিসন্ধির একটা ঝাঁকিদর্শন হয়। ধর্মীয় মেরুকরণ যেখানে মাছের চোখ, সেখানে অবশ্য তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াটা অকাজের গণ্য হয় না। রাজনৈতিক প্রবাহ ঠিক বার্তা দিলে বলা যায়, ভোট যত এগবে, ‘সন্ত্রাসবাদী, মুসলমান জঙ্গি তৎপরতা’-র হদিশও তত বেশি পাওয়া যাবে। হাওয়া গরমের চেষ্টাও চলছে বিরামহীন। ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ নেত্রী সাধ্বী প্রাচী শুনিয়েছেন তাঁর বিশ্বাসের তত্ত্ব- দেশজুড়ে সকলের ডিএনএ এক। শুধু যাঁরা গরু খান, তাঁদেরটা আলাদা। যোগীর জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতিকে সমর্থন জানিয়ে তাঁর হুঁশিয়ারি, দুই সন্তান ঠিক আছে। কিন্তু পাঁচ স্ত্রীর দু’টি করে সন্তান হলে ব্যাপারটা কেমন হয়, ভাবা দরকার।
রামমন্দির তৈরি হওয়া স্রেফ সময়ের ব্যাপার। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল। তিন তালাক নিষিদ্ধ। বাকি শুধু অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। দিল্লি হাই কোর্টের এক বিচারপতি সম্প্রতি সরকারকে সেই লক্ষ্যে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একটার পর একটা ঘটনা জুড়তে থাকুন। সামনে রাখুন ‘মিনি ইন্ডিয়া’-সহ (উত্তরপ্রদেশ) পাঁচ রাজ্যের ভোটপর্ব। দেখবেন, ‘স্নো বল এফেক্ট’-এর হাতেগরম উদাহরণ কেমন হয়। ‘বীজতলা’ এভাবেই তৈরি হয়।