সুকুমার সরকার, ঢাকা: জাল ফেললেই মিলছে কঙ্কাল-খুলি। এক-আধটি নয়, গত এগারো মাসে পাওয়া গিয়েছে অন্তত ৩২৫টি লাশ। মৎস্যজীবীদের জালে উঠে আসছে মনুষ্য দেহাবশেষ। বাংলাদেশের নদ-নদী ও সাগর থেকে গত ১১ মাসে এই পরিমাণ লাশ উদ্ধার হওয়ায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। উদ্ধার হওয়া দেহগুলির মধ্যে ৪৯ জনকে হত্যার করা হয়েছে বলে খবর।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের জেলা জামালপুরের মাদারগঞ্জে যমুনা নদী থেকে ব্যাগ ভরতি মানুষের মাথার খুলি ও হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। সম্প্রতি, বন্দরনগর চট্টগ্রাম ইপিজেড থানা এলাকা থেকে অপহৃত শিশু আয়াতকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর দেহ ছ’টুকরো করে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। হত্যার পর নদীতে কেন লাশ ফেলা হচ্ছে? উত্তরে পুলিশ জানিয়েছে, নদীতে লাশ ফেলে দেওয়ার পর দ্রুত তাতে পচন ধরে। ফলে উদ্ধারের আগেই লাশের চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। এতে আর লাশ শনাক্ত করা যায় না। নিজেদের আড়াল করতেই হত্যাকারীরা নদীতে লাশ ফেলে দেয়।
[আরও পড়ুন: ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা, ফুটবল উত্তাপে বাংলাদেশে বন্ধুর হাতে খুন বন্ধু!]
পুলিশ আরও জানিয়েছে, হত্যার পর লাশ গুম করার নিরাপদ স্থান হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, বংশী, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদী। মাঝেমধ্যেই এসব নদী থেকে পচাগলা লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। গত ১১ মাসে শুধু বুড়িগঙ্গা নদী থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে ৪১টি লাশ। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন স্থানে হত্যার পর লাশ ফেলা হচ্ছে নদীর নির্জন স্থানে। পরে উদ্ধার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পচা-গলা লাশের পরিচয় জানা সম্ভব হয় না। ফলে বেশিরভাগ সময় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে কবর দেওয়া হয়। কিছু লাশ চিহ্নিত হলেও তথ্য-প্রমাণের অভাবে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা যায় না।
নদী থেকে লাশ উদ্ধার বিষয়ে নৌ পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি শফিকুল ইসলাম বলেন, “নৌপথে কিংবা নদী থেকে উদ্ধার করা প্রতিটি লাশের তদন্ত করা হয়। তবে বেশির ভাগ লাশে পচন ধরায় শনাক্ত করা যায় না। এতে তদন্তে বাধা তৈরি হয়। লাশের পরিচয় জানা গেলে হত্যারহস্য উদঘাটন সহজ হয়। অপরাধীরাও ধরা পড়ে।” অপরাধ বিশ্লেষক নুর খান লিটন বলেন, “দেশে যখন রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করে, তখন খুনখারাপি বেড়ে যায়। নদী থেকে পর পর বুয়েট শিক্ষার্থী-সহ ১১ মাসে এই যে এতগুলো লাশ উদ্ধার হয়েছে, এতে উদ্বেগের কারণ আছে। এসব ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। অপরাধীরা গ্রেপ্তার না হলে এ প্রবণতা বাড়তে থাকবে।”
নৌ পুলিশের তথ্য বলছে, নদীতে ফেলে যাওয়া লাশের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে ৩২৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে চলতি নভেম্বরে নদী থেকে সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে গত ২১ মাসে দেশের নদীগুলো থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৬৭৯টি লাশ। ২০২১ সালে নদী থেকে উদ্ধার করা ৩৫৭টি লাশের মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৩৬টি, ময়নাতদন্ত ছাড়া পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ১৯৮টি লাশ। শনাক্ত করা গেছে ২৬৯টি আর শনাক্ত করা যায়নি ৮৮টি লাশ।
এসব লাশের বেশির ভাগের পরিচয় না মেলায়, হত্যা না দুর্ঘটনা তা নিশ্চিত হওয়া নিয়ে বিপাকে তদন্তকারী সংস্থা। কিছু লাশের ক্ষেত্রে শরীরে আঘাতের চিহ্ন পেয়ে পুলিশ হত্যা মামলা করেছে। যেসব লাশের শরীরে হত্যার আলামত পাওয়া যায় না সেগুলোর ক্ষেত্রে অপমৃত্যুর মামলা হয়। আর বেশির ভাগ পরিচয়হীন লাশ কবরের জন্য দিয়ে দেওয়া হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটির রহস্য উদঘাটন করতে পারলেও মামলা বছরের পর বছর তদন্তের বেড়াজালে আটকে আছে।