বিশ্বদীপ দে: গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। গোটা পৃথিবীর চোখ এখন প্যারিসে। কিন্তু ২০২৪ সালের অলিম্পিকে আচমকাই ছায়া ফেলতে শুরু করেছে ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিক! 'মিউনিখ ম্যাসাকার'-এর কথা মনে করিয়ে ইজরায়েলের অ্যাথলিটদের হুমকি দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। আর সেই প্রসঙ্গেই পাঁচ দশক আগে প্যালেস্তিনীয় জঙ্গিদের ভয়ংকর হামলার দুঃস্মৃতি ফিরে আসতে শুরু করেছে। লাইভ টেলিভিশনে ৯০ কোটি মানুষের চোখ সেই সময় ছিল অলিম্পিক ভিলেজের দিকে। সেই গা শিরশিরে কদর্য হত্যাকাণ্ডের ধাক্কায় খেলার উত্তেজনা চলে গিয়েছিল সাইডলাইনে। হিংসা ও সন্ত্রাসই ছিল কাগজের শিরোনামে। ঠিক কী হয়েছিল?
১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিক। ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ নামের এক প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর আটজন সদস্য মিলে সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে আগে ঢুকে পড়ে অলিম্পিক ভিলেজে। তাদের হাতে কালাশনিকভ। সঙ্গে ছিল গ্রেনেডও। আর লক্ষ্য ছিল ইজরায়েলি অ্যাথলিটরা। একজন ওয়েটলিফটার ও একজন কুস্তি কোচকে ঘটনাস্থলেই খুন করে জঙ্গিরা। অপহরণ করে নেয় ৯ জনকে। তাঁদের মধ্যে খেলোয়াড়দের পাশাপাশি ছিলেন কোচরাও। সকলকে পণবন্দি রেখে জঙ্গিরা দাবি করে ইজরায়েলের হাতে বন্দি ২৩৪ জন পণবন্দিকে ছাড়লে তবেই মুক্তি দেওয়া হবে অপহৃতদের। গোটা বিশ্ব শিউরে উঠেছিল এই ঘটনায়। অলিম্পিকের ইতিহাসে এ একেবারে নজিরবিহীন। লাইভ টেলিভিশনে ৯০ কোটি মানুষের চোখ ছিল অলিম্পিক ভিলেজের দিকে। শেষপর্যন্ত বন্দিদের উদ্ধারে গুলির লড়াই শুরু করে জার্মানি (তখন পশ্চিম জার্মানি) পুলিশ। শেষপর্যন্ত আটজন জঙ্গির মধ্যে পাঁচজনেরই মৃত্যু হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাকি ৯ পণবন্দি ও এক জার্মান পুলিশ অফিসারের মৃত্যু আটকানো যায়নি। সংক্ষেপে এই ঘটনাই 'মিউনিখ ম্য়াসাকার'।
গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ
[আরও পড়ুন: খাদ্যপণ্য অগ্নিমূল্য! তথাপি ‘খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ ভারত’, দাবি করলেন মোদি]
ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গোল্ডা মেয়ার। ১৯৭২ সালের ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সেই রাতের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ''যদি স্কিৎজোফ্রেনিয়ার কোনও মূর্ত অভিব্যক্তি থাকে তবে সেটা ছিল সেই রাতটা।'' মন্ত্রী-পারিষদদের সঙ্গে নিয়ে জেরুজালেমে নিজের বাড়িতে বসেও তাঁর চোখ ছিল সেই মিউনিখের দিকে। সেখান থেকে কী খবর আসে তা জানতে উৎকণ্ঠায় অধীর হয়ে উঠছিলেন গোল্ডা। রাত একটা নাগাদ মেলে এক দারুণ খবর। পশ্চিম জার্মানির সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয় সমস্ত জঙ্গিদেরই নিকেশ করা গিয়েছে। এবং ইজরায়েলি পণবন্দিদের উদ্ধার করা হয়েছে। সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির ইজরায়েলি রাষ্ট্রদূতের কাছে পৌঁছতে থাকে অন্য খবর। তিনি জেরুজালেমে খবর পাঠান, গুলির লড়াই এখনও শেষ হয়নি। ঘটনাস্থলে ঠিক কী হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না। সবটাই এখনও কুয়াশায় ঢাকা। শেষপর্যন্ত মোসাদের তৎকালীন প্রধান জাভি জামির গোল্ডাকে ফোন করে বলেন, ''আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, কোনও অ্যাথলিটকেই উদ্ধার করা যায়নি। আমি তাঁদের দেখেছি। একজনকেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি।''
এর পরই নেমে আসে শোকের ছায়া। কেবল ইজরায়েল নয়, বিশ্বজুড়ে। পবিত্র খেলাধুলোর স্থান সব কিছুর উপরে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এই কাপুরুষোচিত হামলা ঘিরে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। এই ট্র্যাজেডির সূত্রপাত হয় ৫ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ। ৮ প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি ঢুকে পড়ে মিউনিখের অলিম্পিক ভিলেজে। এবং তিনটি অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে দুটি অ্যাপার্টমেন্টই দখল করে ফেলে তারা। তাদের হাতে প্রাণ হারান মোশে ওয়েনবার্গ ও জোসেফ রোমানো নামের দুই অ্যাথলিট। পণবন্দি করা হয় ইজরায়েলের ৯ অলিম্পিয়ানকে। ২৩৪ জন পণবন্দিকে ছাড়লে তবেই মুক্তি দেওয়া হবে তাঁদের। এই শর্তের কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সেই শর্ত মানা হয়নি। বরং অপারেশন শুরু করে জার্মানির পুলিশ।
মিউনিখের অলিম্পিক ভিলেজের সামনে ক্যামেরাম্যানরা
[আরও পড়ুন: অলিম্পিকে শুরু ভালোবাসার সফর, চিনের সোনাজয়ী শাটলারকে বিয়ের প্রস্তাব সতীর্থের]
এই ভয়ংকর ঘটনাই জন্ম দিয়েছিল ‘অপারেশন র্যাথ অফ গড’-এর। বাংলায় যার অর্থ ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’। আসলে মিউনিখে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার পর ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ ফের একটি বিমান অপহরণ করে ফেলে। লুফথানসার সেই বিমানটিকে হাইজ্যাক করে তারা দাবি করে জার্মানির (তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির) জেলে থাকা তিন জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়া হোক। এর পরই নড়েচড়ে বসেন গোল্ডা। পুরোদমে প্ল্যান কষা শুরু হল। ডাক পড়ে মোসাদের। নীল নকশা ছকা হল এক গুপ্ত মিশনের। সেই মিশনের নামই ‘অপারেশন র্যাথ অফ গড’। মিশনের টার্গেট ছিল মিউনিখ অলিম্পিকের সময় হামলার পিছনে থাকা চক্রীরা! মিউনিখ হামলার মাত্র ছসপ্তাহের মধ্যেই রোমে মৃত্যু হয় ওয়ায়েল জোয়াইটার। মোসাদ এজেন্টদের হাতে গুলি খেয়ে মরতে হয় প্যালেস্তিনীয় ওই অনুবাদককে। সন্দেহ ছিল, ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’কে অর্থ জোগান দেন ওয়ায়েল। নিজের বাড়ির লবিতেই অতর্কিত মৃত্যুর ছোবলে ঢলে পড়েন তিনি। সেই শুরু। পরবর্তী দুই দশক ধরেই এই অপারেশন চলেছিল। কিন্তু অভিযোগ উঠতে থাকে, সব সময় মোসাদ যে প্যালেস্তিনীয়দের আক্রমণ করেছে তাঁরা সকলেই প্রত্যক্ষ ভাবে ‘মিউনিখ ম্যাসাকারে’র সঙ্গে জড়িত, তা নয়। অনেকেই বুদ্ধিজীবী কিংবা রাজনীতিক।
ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার
তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু অলিম্পিকের আসরে এমন রক্তপাতের বীভৎসতার রেশ ক্রীড়াক্ষেত্রেও পড়েছিল। অলিম্পিকের নিরাপত্তায় সেই থেকেই শুরু হয় কড়া থেকে আরও কড়া বন্দোবস্তের মতো পদক্ষেপ। এদিকে সেই প্রথম ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের দিকে নজর পড়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চের। যার প্রভাব আজও রয়ে গিয়েছে। নতুন করে ইজরায়েলে হামাসের হামলা ও তার জবাব দিতে ইজরায়েলের সেনার লাগাতার গাজায় আক্রমণের সাক্ষী থাকছে বিশ্ব। এদিকে সন্ত্রাসকেও যে রাজনৈতিক 'টুল' হিসেবে ব্যবহার করা যায় সেটাও বিশ্ব সেই প্রথম দেখল। পরবর্তী পৃথিবীতে সেটাই চরম আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের অলিম্পিক কেবল খেলাধুলোর ময়দানই নয়, কাঁপিয়ে দিয়েছিল রাজনৈতিক আঙিনাকেও। যার রেশ আজও রয়ে গিয়েছে।
প্রতীকী ছবি