ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: একুশের মঞ্চ থেকেই একুশের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক তার দু’দিন বাদে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে একপ্রকার ভোটের বাদ্যি বাজিয়ে দিলেন তিনি। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম দলের সাংগঠনিক স্তরে এত বড় পরিবর্তন করতে দেখা গেল তৃণমূল নেত্রীকে। দলের কোর কমিটি বদলাল, রাজ্য কমিটি বদলাল, প্রায় প্রতিটি জেলাস্তরে সংগঠন বদলাল, এমনকী যুব সংগঠনেও আমূল বদল আনলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)।
তৃণমূল নেত্রীর সাংগঠনিক রদবদলের সিদ্ধান্তে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়গুলি কী কী?
এক তারুণ্যে জোর। কোচবিহারে পার্থপ্রতিম রায়, নদিয়ায় মহুয়া মৈত্র (Mahua Moitra), হাওড়া শহরে লক্ষ্মীরতন শুক্লা, বাঁকুড়ায় শ্যামল সাঁতরা। একুশের আগে তৃণমূলনেত্রীর বাছাই করা টিমে জেলা সভাপতি পদে একের পর এক তরুণ মুখ। আরও একটি বিষয় হল স্বচ্ছতা। জেলাস্তরে তো বটেই রাজ্য কমিটিতেও জায়গা দেওয়া হয়েছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের।
২০১৯ লোকসভায় বিজেপির ভাল ফলের পর গত প্রায় ১ বছর ধরে মমতা নিজে দলের নেতানেত্রীদের মূল্যয়ন করেছেন। আর নেত্রীর মূল্যয়ন যারা যারা ‘ফেল’ করেছে, তাঁদের হয় পুরোপুরি সরে যেতে হয়েছে নাহয় ক্ষমতা কমানো হয়েছে। আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই কাটমানি, রেশন দুর্নীতি, আমফান বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ দুর্নীতির মতো একের পর এক অভিযোগে বিদ্ধ হচ্ছিল তৃণমূল। যা কাজে লাগিয়ে একুশে বাজিমাত করতে চাইছিল গেরুয়া শিবির। এবার তৃণমূলনেত্রী একেবারে জেলাস্তর থেকে তৃণমূলস্তর পর্যন্ত দুর্নীতি মুক্ত করার কাজ শুরু করলেন। সেজন্যই হয়তো মহুয়া মৈত্রের মতো নেত্রী যিনি কিনা প্রকাশ্যে দলের নিচুতলার দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছেন, তিনিও জেলা সভাপতি পদে উন্নীত হলেন। আরও একটি কাজ মমতা করলেন, সেটা হল নিস্ক্রিয়দের সরিয়ে দেওয়া। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার দরুন দলের অনেক নেতাই বড় পদ ধরে বসেছিলেন, কিন্তু মাঠে ময়দানে সেভাবে দেখা মিলছিল না তাঁদের। তাঁদেরও এবার হয় ছেঁটে ফেলা হল নাহয় কম গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে দেওয়া হল। যেসব নেতাদের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র দুর্নীতি বা নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ আছে, তাঁদেরই শাস্তি দিলেন মমতা। উদাহরণ হিসেবে নদিয়ার প্রাক্তন জেলা সভাপতি গৌরীশংকর দত্ত, বা পুরুলিয়ার জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো, বা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের বলা বলা যেতে পারে। এঁরা প্রত্যেকেই হয় পদ খুইয়েছেন, নয় কম গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন।
[আরও পড়ুন: ‘পুলিশ শাসকদলের কর্মীর মতো আচরণ করছে কেন?’, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা চাইলেন রাজ্যপাল]
কিন্তু এখন প্রশ্ন হল। এত বড় রদবদলের পর যদি দলে ভাঙন ধরে, যারা বড় বড় পদ খোয়ালেন তাঁরা যদি বিজেপি বা বাম-কংগ্রেসে নাম লেখান? মমতা বন্দ্যপাধ্যায় যে সেদিকটা একেবারে ভাবেননি, তা নয়। সম্ভবত সে জন্যই জেলাস্তরে পর্যবেক্ষক পদটি সরিয়ে দিয়ে একজন করে ‘চেয়ারম্যান’ নিয়োগ করেছেন তিনি। তৃণমূলের সাংগঠনিক স্তরে এই পদটি নতুন। আসলে তৃণমূলনেত্রী কারও কোনও অসন্তোষ রাখতে চান না। সেজন্যই হয়তো নদিয়ায় উজ্বল বিশ্বাস, কোচবিহারে বিনয়কৃষ্ণ বর্মন, পুরুলিয়ায় শান্তিরাম মাহাতোরা সভাপতির পদ খুইয়েও চেয়ারম্যানের পদ পেলেন। বীরভূমের আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তর ২৪ পরগনায় নির্মল ঘোষদের মতো প্রভাবশালী নেতাদেরও দেওয়া হল চেয়ারম্যানের পদ।
[আরও পড়ুন: ব্যাপক রদবদল তৃণমূলের সাংগঠনিক স্তরে, রাজ্য কমিটিতে এলেন ছত্রধর মাহাতো]
বেশ কিছুদিন ধরেই রাজ্য রাজনীতিতে যাকে নিয়ে জল্পনা চলছিল, সেই শুভেন্দু অধিকারীকে (Suvendu Adhikari) আরও খানিকটা কাছে টানলেন নেত্রী। দলের সাত সদস্যের কোর কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন শুভেন্দু। পাহাড়ের প্রতিনিধি হিসেবে কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন শান্তা ছেত্রীও। সঙ্গে রয়েছেন সুব্রত বক্সি, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং অভিষেক বন্দ্যাপাধ্যায়। কোর কমিটি থেকে বাদ পড়তে হয়েছে খোদ অরূপ বিশ্বাসকে। একসময় যাকে ‘দিদি’র কাছের লোক বলে মনে করা হত। সংগঠনে তিনিই এখন ব্রাত্য। কদিন আগে তৃণমূলের ‘রাঘব বোয়াল’দের দুর্নীতি নিয়ে সরব হওয়া রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও রাজ্য কোর কমিটিতে জায়গা পেলেন।অর্থাৎ ২১-এর আগে মমতার স্পষ্ট বার্তা। দলে কেউ ব্রাত্য নয়। তবে দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতারাই অগ্রাধিকার পাবেন।
The post একুশের আগে তারুণ্যে জোর, ‘দুর্নীতি’ সরিয়ে ‘স্বচ্ছতা’ অভিযানে নামলেন মমতা appeared first on Sangbad Pratidin.