shono
Advertisement
Turkey

১২ হাজার বছর আগের একদিন

মাটি খুঁড়ে মেলে ধুলোয় ঢাকা অজানা ইতিহাস।
Published By: Suchinta Pal ChowdhuryPosted: 03:06 PM Jul 14, 2024Updated: 03:54 PM Jul 14, 2024

‘গোবেক্লি টেপে’। তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। নব্য প্রস্তর যুগের স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করছে যা। এখানে কি ছিল মন্দিরের নকশা? কলমে সুমন প্রতিহার

Advertisement

২০ জুলাই, ২০১৪। জার্মানিতে নিজের ঘরে সাঁতার কাটার সময় হঠাৎই হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে মারা যান বছর ৬১-র জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লাউস শ্মিড (জন্ম ১৯৫৩)। মৃত্যুর আগে বেশ খানিকটা এলোমেলো করে যান মানবসভ্যতার ইতিহাস। মাটি খুঁড়ে জীবন্ত করেন ধুলোয় ঢাকা অজানা ইতিহাস। তাঁর বছর কুড়ির অত্যাশ্চর্য অধ্যবসায়ের ফল তুরস্কের ‘গোবেক্লি টেপে’ (Gobekli Tepe), ইতিহাসের ‘জিরো পয়েন্ট’।

বলা হয়, ১২ হাজার বছর আগে, আদিম মানুষরা তৈরি করেছিল এই ‘গোবেক্লি টেপে’। সময়ের নিরিখে দেখলে– বীজ ছড়িয়ে চাষ-আবাদ তখনও রপ্ত হয়নি, যাযাবর জীবনের সম্বল শিকার। ওই সময় কী বিশ্বাসে, কীসের আশ্বাসে শিকারি মানুষরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল, তা ভাবনাকে দোলা দেয় বইকি। ‘গোবেক্লি টেপে’ কী, কী কারণে এই স্থাপত্য, কেন এখানে মানুষ জড়ো হত, কত দিন পরে ফিরে-ফিরে আসত– সবেতেই নিহিত কৌতূহল অঢেল। রয়েছে আরও একটি মোক্ষম জিজ্ঞাসা– ‘গোবেক্লি টেপে’ কি মানুষের তৈরি প্রথম মন্দির?

উরফা, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের পুরনো এক প্রত্ন-শহর, সেখান থেকে আরও ১২ কিলোমিটার এগিয়ে ‘গোবেক্লি টেপে’। বিস্তীর্ণ সমতলে হঠাৎই ৫০ ফুটের স্ফীত উদরের মতো ভূমিরূপ। ১৯৬০ সালে শিকাগো ও ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকের একটি দল সেখানে পৌঁছেছিল। তবে চিনতে ভুল হয়। দলটির মনে হয়েছিল– এটা প্রাচীন চার্চের কোনও সমাধিক্ষেত্র বুঝি। আবার, নয়ের দশকে একজন পশুপালক এ-অঞ্চলে পাথরে খোদাই করা কিছু প্রাণী-অবয়ব দেখতে পান। সেবারও রহস্যভেদ হয়নি উৎসাহের। তবে তৃতীয়বার ক্লাউস শ্মিডের চোখ এড়িয়ে যায়নি। শুরু হল খনন পর্ব, ধুলোর পরত সরিয়ে বেরিয়ে এল ইতিহাসের চুপকথা।

‘গোবেক্লি টেপে’-য় বৃত্তাকারে সাজানো আছে কিছু ভারী পাথর। মাঝখানের পাথরের আকৃতি ইংরেজি বর্ণমালার ‘টি’-র মতো, খাড়াভাবে পোঁতা একটি পাথরের মাথায় অত্যন্ত যত্নে রাখা রয়েছে আরও একটি পাথর। পাথরটা ৬৫ ফুট উঁচু, আর ৭০০ থেকে ১০০০ কিলো ওজনের। সেই বড় পাথরটাকে ঘিরে বাকি খাটো পাথরের মুখ ভিতরের দিকে। সেসব পাথরে খোদাই করা হয়েছে নানা প্রাণী, পাখির প্রতিকৃতি। আর হ্যাঁ, সঙ্গে রয়েছে এমন কিছু আকৃতি, যা নিয়ে হরেক ভাবনার আঁকিবুঁকি চলতে থাকে। প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে সাপ, কখনও একা, কখনও দোকা, কখনও-বা দলে দলে। সঙ্গে রয়েছে ছোট লেজের ধেড়ে ইঁদুর, পুচকি ইঁদুর, গুহাবাসী খরগোশ, হিংস্র শেয়াল, চিতা, বনবিড়াল, শক্তিশালী বাঁকানো শিংওয়ালা বড় ভেড়া, বড় কাঠবিড়ালি, নেউল, গন্ধগোকুল, নেকড়ে, ব্যাজার, বন্য গাধা, লালরঙা হরিণ, ছোপ-হরিণ, বন্য বলদ, শকুন, ঈগল-সহ অনেক ছোট পাখি, এমনকী বিলুপ্ত ডোডো পাখিও। ছবিতে বিছে, মাকড়সার কদরও কিছু কম ছিল না।

অপরিচিত প্রায় ২৪ হাজার ছবি, চেনা গিয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ৪৭১। ‘নব্য প্রস্তর যুগ’-এর সেই সময়ে মানুষ গরু, ছাগল, ভেড়া আর শুয়োরকেই শুধু বাগে আনতে পেরেছিল, মাংস আর দুধের জন্য তাদের পোষ মানিয়েছিল। অবশ্য এর বহু আগে থেকেই কুকুর মানুষের সঙ্গী। প্রশ্নের উদয় ঘটে: বিশালাকার পাথরগুলো শিকারি মানুষগুলো টেনে নিয়ে গিয়েছিল কী করে?

‘গোবেক্লি টেপে’-র ৪৩ নম্বর পিলারকে বলা হয় ‘শকুনের স্তম্ভ’, যেখানে খোদিত নক্ষত্রপুঞ্জের সমাবেশ থেকে আকাশ-চেতনার আভাস পাওয়া যায়। আবার অনেক গবেষকের মতে, স্তম্ভে শকুনের উপস্থিতি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতীক নয়, অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার স্থল। ১৮ নম্বর পিলারে রয়েছে সাংকেতিক চিহ্ন। ইংরেজি বর্ণমালার ‘এইচ’ ও তার দুই পাশে অর্ধবৃত্তাকার প্রথম বন্ধনীর সংকেত। আনাটোলিয়া তুরস্কের ব্রোঞ্জ যুগের আদিম জনজাতি লুভিয়ান্সদের ব্যবহৃত সংকেতে নাকি এর অর্থ ‘ঈশ্বর’। তাহলে কি গোবেক্লি টেপেতেই রয়েছে ঈশ্বরচিন্তার প্রাচীনতম নিদর্শন?

‘গোবেক্লি টেপে’-র উঁচু ঢিপিতে বসে প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লাউস শ্মিড আসলে ১২ হাজার বছর আগের অতীতের ছবি এঁকেছেন। সূর্যের নরম আলোয় উজ্জ্বল হয়ে পাশে বইছে নদী, সে-নদীর জল ডেকে নিয়ে আসে পরিযায়ী হাঁসেদের, তাদের প্রতিবেশী হয়ে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ সমতল ভূমিতে চরে হরেক হরিণ-সহ বন্য বলদ। সেই উর্বর ভূমি গর্বের সঙ্গে বড় করেছে বাদাম-সহ নানা ফলের গাছ। শুধু ফলের গাছ নয়, রয়েছে বন্য বার্লি আর চূড়ান্ত পুষ্টিকর ইমার আর ইঙ্কর্ন গমের প্রজাতি। বন্য গমের এই প্রজাতি থেকেই আধুনিক সমস্ত বাহারি গমের আবির্ভাব– যদিও তারা পুষ্টিগুণে বহু পিছিয়ে। পরিবেশটা স্বর্গীয়, আর তা শিকারি ও যাযাবর প্রবণতার মানুষদের আকর্ষণ করবে স্বাভাবিক। তবে অস্বাভাবিক এটা যে, তারা এখানে বসবাসের জন্য আসেনি, তৈরি করেছে পাথরের স্থাপত্য।

ভারী পাথরের তলায় পাওয়া গিয়েছে ‘ক্যালসিয়াম অক্সালেট’। শস্যকে ভিজিয়ে, থেঁতো করে, গঁজানো হলে তৈরি হয় এই রাসায়নিক। খুব সোজা করে বললে– মদ্যপানের প্রমাণ। এটাকে সমবেত ভোজনের স্থান বা বার্ষিক মিলনমেলা বলেও ভাবা যেতে পারে। হয়তো এসব কর্মকাণ্ড বিবর্তনের পথে মানব-গোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল। ৪ লক্ষ বছর আগে, নিয়ন্ত্রিত আগুন ব্যবহারের সঙ্গে-সঙ্গে, একত্রে খাওয়া ও অনুভূতি আদানপ্রদানের অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। যা এন্ড্রোফিন ক্ষরণের মাধ্যমে ভাল লাগার অনুভূতি তৈরি করে। এ-বিষয়ে চমৎকার কথাটা লিখেছেন মার্ক ফরসিথ, ‘আ শর্ট হিস্ট্রি অফ ড্রাঙ্কেননেস’ বইয়ে– শিকারি, যাযাবর মানুষগুলো খাদ্যের অভাবে হয়তো চাষ-আবাদ শুরু করেনি, করেছিল সমবেত মাতাল হবে বলে!

‘গোবেক্লি টেপে’-তে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা পাথরের অস্ত্রের রেডিও কার্বন ডেটা বলে, সেটা ‘নব্য প্রস্তর যুগ’। সে-সময় পাথরে ছবিগুলি খোদাই করা হয়েছিল নানা আকারের পাথরের সাহায্যেই। পাথরে ইংরেজি বর্ণমালার ‘টি’-র আকারে গবেষকরা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মাথা, ঘাড়, কাঁধ কল্পনা করেছেন। কল্পনাকে মিলিয়ে দিয়েছে পাথরের পাশ বরাবর নেমে আসা হাতের ড্রয়িং, রয়েছে আঙুলও, যা কোমরবন্ধনীতে এসে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে। ‘গোবেক্লি টেপে’-র আগের সমস্ত খোদাই করা স্থাপত্যে এবং গুহাচিত্রে ছিল প্রাণীদের আধিক্য ও আধিপত্য। কিন্তু এখনাকার স্থাপত্যে মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে– এখন আর প্রাণীরা নয়, বরং তারা-ই ‘বস’।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের পুরনো এক প্রত্ন-শহর, সেখান থেকে আরও ১২ কিলোমিটার এগিয়ে ‘গোবেক্লি টেপে’।
  • বিস্তীর্ণ সমতলে হঠাৎই ৫০ ফুটের স্ফীত উদরের মতো ভূমিরূপ। ১৯৬০ সালে শিকাগো ও ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকের একটি দল সেখানে পৌঁছেছিল।
  • নয়ের দশকে একজন পশুপালক এ-অঞ্চলে পাথরে খোদাই করা কিছু প্রাণী-অবয়ব দেখতে পান।
Advertisement