শাহজাদ হোসেন, ফরাক্কা: জমিদার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে গঙ্গা। বাড়ির খিড়কিগুলিতে আছড়ে পড়ে নদীর হাওয়া। গোটা বাড়ি জুড়ে সময়ের থাবা। দাঁত বের করে রয়েছে পুরনো ইঁট। মোটা থামগুলি যেন অতীত গৌরব গাথার দলিল। বর্ষায় নদী ফুঁসে ওঠে আজও। তবু শরৎ এলে ফের ঝলমলে হয়ে ওঠে জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালান। তৈরি হয় একচালার দেবীমূর্তি। এলাকার মানুষও সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন। মুর্শিদাবাদের (Murshidabad) নিমতিতা জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোই যে তাঁদের মূল আকর্ষণ।
একসময় এই রাজ বাড়িতে দুর্গাপুজো (Durga Puja) উপলক্ষে বসত পালাগান, ঝুমুর, যাত্রা বসত মেলা। পুজোর ক’টাদিন যেন নববধূর সাজে সেজে উঠত রাজবাড়ি। ষষ্ঠীর দিনে হতো দেবীর আবাহন। গ্রামের মানুষজন রাজবাড়িতে পাত পেড়ে খেতেন। পুজোর ক’দিন হরেক অনুষ্ঠান, অঢেল খাওয়াদাওয়া। দশমীর দিন ওড়ানো হতো নীলকন্ঠ পাখি। কালের নিয়মে আজ সব ম্লান।
লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্র ধরে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জমিদার রামচন্দ্র চৌধুরীর দুই সন্তান গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরী তৈরি করেন নিমতিতার রাজবাড়ি। ইতালিয়ান ধাঁচের বাড়িতে রয়েছে পাঁচটি উঠোন এবং দেড়শো ঘর। এই বাড়িতে একসময় এসেছিলেন বহু গুণীজন। দ্বারকানাথের ছেলে রায়বাহাদুর জ্ঞানেন্দ্রনাথ চৌধুরীর মেয়ের বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে এসেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবিকে নিয়ে আসা হয়েছিল যে গাড়িতে, আজ সেটি পড়ে আছে অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
[আরও পড়ুন: নবজাতকদের আংটি, ৫৬ পদে সাজানো থালি, মোদির জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজন বিপুল]
তখন পুজোর সময় গোটা বাড়িতে আলো ঝলমল করত। পুজোয় নহবত বসত। পুজো দালানে থরে থরে সাজানো থাকত ভোগ। ভিয়েন বসত সেকালে। একবার নিমন্ত্রণ জানান হয়েছিল কলকাতার স্টার থিয়েটার গ্রুপকে। তখনও রাজবাড়ির ঝাড়বাতিতে বনেদিয়ানা বর্তমান ছিল। এই রাজবাড়িটি ধরা আছে সত্যজিত রায়ের ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’, ‘সমাপ্তি’র ফ্রেমে। নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত চিত্রসাংবাদিক ব্রায়ান ব্রেক তরুণী অপর্না সেনকে ‘মনসুন ইন ইন্ডিয়া’ নামে ফটো স্টোরির করিয়েছিলেন নিমতিতা জমিদার বাড়িতে। এরপর কালের নিয়মে কড়ি-বরগাগুলোর দখল নিয়েছে ঘুণপোকায়। এককালে যেখানে আলতা পায়ের ছাপ থাকত, আজ সেখানে আগাছায় ভরে গিয়েছে। বিষাক্ত সরীসৃপরা আশ্রয় নিয়েছে ইটের খোঁদলে। তবুও বাড়ির ঠাকুর দালানে আজও উমা আসেন।
এখন সে সবই অতীত। নিয়ম মেনে পুজো হয় বটে। ঢাকও বাজে। কিন্তু জৌলুস সব মুছে গিয়েছে। বাড়ির বাসিন্দারা একে একে ভিটে ছেড়েছে প্রত্যেকেই। তাঁদের দেওয়া টাকায় পুজোটুকু হয় নমো-নমো করে। তবু পুজোর কটা দিন স্থানীয় মানুষরা মায়ের দালানে ভিড় জমান মনের টানে। বংশের উত্তরসূরীরা কেউ থাকেন বিদেশে, কেউ বা আবার কলকাতায়। ভগ্নপ্রায় জমিদারবাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। নেই হাতিশালা ও ঘোড়াশালা। প্রাসাদের নাচমহলের ঝাড়বাতিটি আজ আর নেই। শোনা যায়না সারেঙ্গির আওয়াজ। নর্তকীদের নুপূর আর বাজে না। বাতাসে মেলে না আতরের সুগন্ধি। ওড়ে না রঙিন জলের ফোয়ারা। তবু আশ্বিণের শারদ প্রাতে শোনা যায় দেবীর আগমনী গান।