সেন্সর বোর্ডের কাঁচি এড়িয়ে ছবি দেখার সুযোগ এখন আর এদেশে নেই! নিতান্ত বাণিজ্যিক ছবিকেও রাজি হতে হয় গা বাঁচিয়ে প্রদর্শনের শর্তে। তার উপর যদি ছবির পর্দায় ধূমপান থাকে, তবে তো কথাই নেই! বিধিসম্মত সতর্কীকরণ ছবির উপর এসে ফ্রেমের বারোটা বাজিয়ে দেবে। এই সব কিছুর হাত থেকে সবার সিনেমা দেখার স্বাধীনতা উদযাপন করছে ২২তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। লিখছেন অনির্বাণ চৌধুরী
Advertisement
কত দিন, ঠিক কত দিন আপনার নিজেকে স্বাধীন মনে হয়নি বলুন তো?
মানছি, স্বাধীন আর স্বাধীনতা শব্দদুটো বড্ড গোলমেলে। তার সঙ্গে আবার কোথাও একটা গিয়ে জুড়ে যায় রাষ্ট্রনীতির নিয়মমাফিক অধিকার পাওয়া আর বদলে কর্তব্য পালন করে চলার সমান্তরাল সম্পর্কও। কিন্তু, আমরা কি সুনাগরিক নই? বছরে সময় এলে সুড়সুড় করে কর জমা করছি তো সরকারি খাতে। নিয়ম মেনে রাস্তা না পেরোলেও ট্রাফিকের বাতি লাল হয়ে গেলে সিগন্যালে গাড়ি-সমেত দাঁড়াতে ভুলি না। আকণ্ঠ মদ খেয়েও সংযত করে রাখি নিজেকে- সুনাগরিকের রাস্তায় বেলেল্লাপনা করা নেহাতই অনৈতিক! এরকম আরও কত কী রয়েছে নিয়ম মানার খাতে।
তার পরে যদি আমাদের মর্জি হয়, আমরা কেন একটা ছায়াছবি আনকাট অবস্থায় দেখতে পারব না? সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন, ছোট করে বললে সেন্সর বোর্ড কেন সেই স্বাধীনতা দেবে না?
জানি, এই প্রশ্নটা তুলে লাভ নেই। অনেক দিন ধরেই ভারতের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তের মানুষ, যাঁরা ছায়াছবি দেখতে ভালবাসেন, তাঁরা এই মর্মে গজরাচ্ছেন। কিন্তু, বছরের কয়েকটা দিনে কলকাতা সেই দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। নভেম্বর এলেই উত্তুরে হাওয়ার হাত ধরে শহরে জাঁকিয়ে বসে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। আর একগুচ্ছ ছবি, পৃথিবীর সারা প্রান্তের, পুরোপুরি আনকাট অবস্থায় তুলে দেয় আমাদের হাতে। সেখানে সেন্সর বোর্ডের জারিজুরি খাটে না। কেন না, এ হল বিশেষ প্রদর্শন! অতএব, আইনত কোনও সমস্যা নেই। সে ভারতের ছবি হলেও আনকাট ভার্সন, বিদেশের তো বটেই! ভাবুন তো, পর্দায় ধূমপান হচ্ছে এবং কোথাও বিধিসম্মত সতর্কীকরণ এসে তাল কাটছে না, এরকম আরাম আপনার চোখ কত দিন পায়নি?
মনে পড়ছে, একদা এই কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেই দেখানো হয়েছিল কেতন মেহতার ‘রং রসিয়া’। সে ছবি ভাল কী খারাপ- সে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। কিন্তু নানা শর্ত পেরিয়ে, প্রচুর দৃশ্যে কাঁচি চালানোর পর সেই ছবি যখন মুক্তি পায়, তার অন্তত বছর চারেক আগেই কলকাতা দেখেছিল পুরো ছবিটা। দেখেছিল গুজরাত দাঙ্গার বিতর্কে জড়িয়ে থাকা নন্দিতা দাশের ‘ফিরাক’। কেন্দ্রের সেই ছবি নিয়ে মতামত যা-ই থাক না কেন, কলকাতা তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায়নি। কখনই ঘামাত না, আজও ঘামায় না! এই শহর সরকারি রক্তচক্ষু এড়িয়েই বছরে অন্তত ৮টা দিন সবার হাতে তুলে দেয় ছায়াছবি দেখার প্রকৃত স্বাধীনতা।
সেই কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবার ২২ বছরে পা দিল। আর আমরা দেখলাম, টিন-এজের কোঠা পার করে ফেলে সে আরও বেশি সাবলীল মুক্ত চিন্তাধারা নিয়ে। কোনও কিছুকেই সে তোয়াক্কা করছে না। অবাধে রুপোলি পর্দায়, শহরের ১৩টি প্রেক্ষাগৃহে, সোল্লাসে বলছে ১৫৬টি দুনিয়া-বাছাই ছবির কথা। সেই ছবি কখনও বা শুধু বিষয়বস্তুর দিক থেকেই চমকে দেয়। অকাতরে, সমান ভাবে রুপোলি পর্দায় বলে যায় সম্পর্কের সাতকাহন। কখনও সেই সম্পর্ক পুরুষ আর নারীর, সমাজের নিয়ম বাঁধা গতে। কখনও বা তা শুধুই দুই পুরুষের বা দুই নারীর। সেখানে শরীর নিয়ে কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। এরকম খোলাখুলি ভাবে স্বাধীনতার উদযাপন এই শহরে খুব বেশি কি দেখা যায়?
দেখা যায় না। সত্যি বলতে কী, সম্পর্কের কথা এমন করে বলতে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবও অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। ওই যে বললাম, তার আর টিন-এজ জড়তাটুকু নেই! সে এখন সব দিক থেকেই সাবালক। তাই সুন্দর ভাবে, গুছিয়ে মনের কথাটুকু বলতে পারে। যা স্বাধীনতা, যা বেঁচে থাকার আসল কথা, তাকে উদযাপন করতে জানে। সেই জন্যই বোধহয় এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে অনেক ছবিতেই ঘুরে-ফিরে এসেছে সমকামী সম্পর্কের কথা। সারা পৃথিবী এই সম্পর্ককে যেমন মান্যতা দিচ্ছে, এই শহরও দিচ্ছে তার রুপোলি পর্দার মধ্যে দিয়ে।
কিন্তু, শুধুই এই নয়! আসলে সম্পর্ক তো বরাবরই ছায়াছবির চিরন্তন আবেদনের জায়গা। তা যেমন যেমন বদলে যায়, তেমন করেই গল্প বোনে রুপোলি পর্দা। এর বাইরেও কিন্তু ছক ভেঙেছে ২২তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। রুপোলি পর্দায় ছড়িয়ে দিয়েছে নেশাতুরতা এবং তা ভেঙে বেরিয়ে আসার গল্প। বলছে, নিজেকে খুঁজে নেওয়ার কথা। পাশাপাশি, খুব বেশি করে জোর দিয়েছে ভারতীয় আর বাংলা ছবির দিকে যা অনেক দিন পর্যন্ত চলচ্চিত্র উৎসবে কিছুটা হলেও যেন কোণঠাসা ছিল। নিন্দুকরা তার সমালোচনা করছেন ঠিকই, কিন্তু কী যায় আসে! ব্যাপারটা দর্শকের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হোক না! যাঁর যা দেখার, তিনি সেটা ঠিক দেখবেন। পছন্দ না হলে বেরিয়ে যাবেন প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে। সেখানেই রয়েছে তাঁর স্বাধীনতা। এই কথাটা কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব ভুলে যায়নি।
সেই স্বাধীনতাই এই বছরে নতুন সাজে ধরা দিল নন্দন চত্বরে। পুরনো চেহারার পুরোটুকু ধুয়ে-মুছে তাই ভোল বদলে ফেলল ছায়াছবি উৎসবের মূল প্রাঙ্গন। বিশেষ করে রবীন্দ্র সদনের দিকটা। সেখানে পার্কিং লটে সুষ্ঠু বন্দোবস্ত হল গাড়ির। যা এত দিন কল্পনাই করা যেত না। পানীয় জলের একটা কল ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটার একটা মুখ ছাড়া অন্যগুলো দিয়ে জল পড়ত না! সেই জায়গায় এবার এসেছে স্বাভাবিক উষ্ণতা আর শীতল জলের কল! তৃষ্ণার শান্তি, সুন্দর কান্তিতে! অনেক দিন ধরে যাঁরা নন্দন চত্বরে আড্ডা দিয়ে অভ্যস্ত, তাঁদের ব্যাপারটা একটু চোখে লাগতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন মানসিকতা বদলে যায়, তেমনই কি বদলের একটা ছাপ শরীরেও পড়ে না? সেই ছাপটা যদি সদর্থক হয়, ক্ষতি কী!
আরও একটা ব্যাপারের কথা না বললেই নয়। এত দিন ধরে দেখেছি, ছবি দেখানোর আগে যে ফ্রি পাস বিলি করা হত, তার মধ্যে কোথাও একটা খুঁজে খুঁজে মরি ব্যাপার ছিল! অনেকে জানতেনই না ঠিক কোন কাউন্টারে গেলে সেই পাস মিলবে! এখন কিন্তু নন্দনের ঠিক সামনে টেবিল পেতে সবার হাতে হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে পাস। কেন না এবারের উৎসবের মূল কথা তো একটাই- সবার জন্য সিনেমা! তাই সবাই যাতে ছায়াছবি উপভোগ করতে পারেন, সেই বিষয়ে কোনও কসুর নেই!
আবার বলি, সেই উপভোগ্যতাও কিন্তু সেন্সরের রক্তচক্ষু এড়িয়েই! সবার জন্য যেমন সিনেমা, তেমনই স্বাধীনতাও তো সবারই জন্য! সেই ব্যাপারটা শহরকে একমাত্র মনে করিয়ে দিচ্ছে এই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবই! মনে করিয়ে দিচ্ছে, বিশ্ব আদতে একটা গ্রামই! আর আমরা সবাই সেই গ্রামের বাসিন্দা। স্বাধীন বিশ্বনাগরিক!
এর পরেও কি সেন্সর বোর্ডের শিক্ষা হবে না?
The post সেন্সর বোর্ডকে তুড়ি মেরে ছায়াছবির স্বাধীনতা উদযাপন করছে কলকাতা appeared first on Sangbad Pratidin.