সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: নৃশংস খুন, রহস্যময় কুয়াশামাখা সিরিয়াল কিলার। এমন যুগলবন্দি মানুষ সহজে ভুলতে পারে না। উনবিংশ শতাব্দীতে খাস লন্ডন শহরে দেখা মিলেছিল জ্যাক দ্য রিপারের। আজও তাকে নিয়ে চর্চার শেষ নেই। এমনই আরও এক খুনি জোডিয়াক কিলার। গত শতকের ছয়ের দশকের শেষদিকে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় একের পর এক খুনের ঘটনায় রীতিমতো ত্রাসের সঞ্চার ঘটিয়েছিল সে। আজও হদিশ মেলেনি সেই নৃশংস হত্যাকারীর। ঠিক জ্যাকের মতোই। তাকে নিয়েও শোরগোল অব্যাহত। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পরে নেটফ্লিক্সের মতো জনপ্রিয় ওটিটি মঞ্চ তাকে নিয়ে তৈরি করে তথ্যচিত্র 'দিস ইজ দ্য জোডিয়াক স্পিকিং'। যা বুঝিয়ে দেয় 'রাশিচক্র খুনি'র জনপ্রিয়তা আজও অটুট। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই আতঙ্ক ও নৃশংসতাকে ভুলতে পারেনি।
আজ পর্যন্ত এই মামলায় একজনই সন্দেহভাজনের সন্ধান পেয়েছিল পুলিশ। তার নাম আর্থার লেই অ্যালেন। সে পেশায় ছিল একজন শিক্ষক। তবে তার কথা পরে। আগে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক ঘটনাক্রম। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের অক্টোবর। মোটামুটি দশ-এগারো মাসের মধ্যে সানফ্রান্সিসকো, লেক বেরিয়েসা, ভাল্লেজো, বেনিসিয়ায় রহস্যময় ভাবে আক্রান্ত হন সাতজন। তাঁদের বয়স ১৬ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। চারজন পুরুষ। তিনজন মহিলা। তবে প্রাণে বেঁচে যান দুজন।
জোডিয়াক কিলারের মতোই জ্যাক দ্য রিপারের সন্ধানও মেলেনি
জোডিয়াক কিলারের প্রথম শিকার ১৬ বছরের বেটি লউ জেনসেন এবং ১৭ বছরের ডেভিড আর্থার ফ্যারাডে। জানা যায়, এই দুই কিশোর-কিশোরীর সেদিনই ছিল প্রথম ডেট। প্রেমিক ডেভিড তার প্রেমিকাকে নিয়ে গিয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার লেক হেরমান রোডে। ১৯৬৮ সালের ২০ ডিসেম্বর দুজনের দেহ আবিষ্কার করেন এক পথচারী। নিজেদের গাড়ির পাশেই পড়েছিল তারা। শরীরে গুলির চিহ্ন। পরের শিকার ২২ বছরের তরুণী ডারলেন ফেরিন। ১৯৬৯ সালের ৪ জুলাই সদ্য মা হওয়া ওই তরুণীকে গুলি করে হত্যা করে জোডিয়াক কিলার। এখানেই শেষ নয়, তাঁর গাড়িতে বসা ১৯ বছরের মাইকেল ম্যাজেউও আহত হন আততায়ীর গুলিতে। কিন্তু তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ভাল্লেজোর পার্কিং লটের এই হামলা নতুন করে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে দেয় আমেরিকায়। ক্রমেই চর্চা শুরু হয়ে যায় জোডিয়াক কিলারকে কেন্দ্র করে। একে একে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে অপরাধী। দিশেহারা হয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু কেন জোডিয়াক কিলার নামে ডাকা হতে থাকে অপরাধীকে? এর পিছনে রয়েছে এমন ঘটনা, যা এই সিরিয়াল কিলারকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।
আসলে পুলিশ ঘটনাস্থল তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনও 'ক্লু' পায়নি পুলিশ। এক্ষেত্রে তাদের 'সাহায্য' করতে এগিয়ে আসে খোদ জোডিয়াক কিলারই! ‘সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল’-এ সংকেতচিহ্ন সমেত চিঠি পাঠাতে থাকে সে। সব মিলিয়ে পুলিশের হাতে আসে ৩৪০টি কোড! কিন্তু বছরের পর বছর ধরে সেই সব কোড থেকে খুনিকে ধরার কোনও সূত্রই মেলেনি। আসলে যে ধরনের কোড খুনি পাঠাত সেগুলিতে বারোটি রাশিচিহ্ন থাকত। তাই খুনির নামকরণ হয়ে গেল 'জোডিয়াক কিলার'।
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী জোডিয়াক কিলারের চেহারা
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে এতগুলো বছর। কিন্তু ধরা পড়েনি খুনি। লেখার শুরুতে আর্থার লেই অ্যালেনের কথা বলা হয়েছিল। তিনিই এই মামলার একমাত্র সন্দেহভাজন। সেই অর্থে একমাত্র বলা হয়তো ঠিক নয়। আসলে অনেকের নামই উঠে এসেছিল প্রাথমিক ভাবে। এই ধরনের খুনের ক্ষেত্রে সেটা স্বাভাবিকও। কিন্তু শেষপর্যন্ত ধোপে টেকেনি বাকিদের নাম। থেকে গিয়েছেন একা আর্থার। কিন্তু কেন? প্রথমত, সে একজন দোষী সাব্যস্ত হওয়া শিশু যৌন নির্যাতনকারী। দ্বিতীয়ত, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী জোডিয়াক কিলারের আদলের সঙ্গে তার আশ্চর্য সাদৃশ্য। ১৯৯২ সালে মারা যায় সে। এর পর মেলে আরও একটা 'ক্লু'। একটা জোডিয়াক ওয়াচ তথা রাশিচিহ্ন ঘড়ি। অর্থাৎ সেই ঘড়ির মধ্যে ছিল রাশিচক্রের ছবি। এরই পাশাপাশি জানা যায়, প্রায়ই নাকি বন্ধুবান্ধবদের কাছে জোডিয়াক কিলার নিয়ে মন্তব্য করত আর্থার। এই সব কিছু একত্র করে অনেকেরই মনে হয় আর্থারই আসলে জোডিয়াক কিলার। কিন্তু প্রমাণ মিলল কই? তার মৃত্যুর তিন দশক পরেও জটিলতা অব্যাহত। কেননা সংবাদপত্রে লেখা তার চিঠিগুলির মূল কপির ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছিল। তা আর্থারের সঙ্গে মেলেনি। ফলে 'অফিসিয়ালি' তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যায়নি। কিন্তু আজও এই মামলায় কুয়াশামাখা তার উপস্থিতি।
বন্ধুবান্ধবদের কাছে জোডিয়াক কিলার নিয়ে মন্তব্য করত আর্থার
২০২১ সালে একদল শখের গোয়েন্দা দাবি করেন, তাঁরা জোডিয়াক কিলারকে খুঁজে পেয়েছেন। তার নাম গ্যারি ফ্রান্সিস পোস্টে। সে একজন সিরিয়াল কিলার হিসেবেই কুখ্যাত। তবে বর্তমানে আর ইহজগতে নেই সে। কিন্তু তার সঙ্গে অভিযুক্তর আদল মেলা বা খুনের প্যাটার্নের মিল যাই থাকুক, তা অকাট্য প্রমাণ হতে পারে না। সুতরাং গ্যারি সাহেবও হিসেবে বাইরেই থেকে যায়।
তবে খুনিকে ধরা না গেলেও করোনা কালে এক সফটওয়্যার ডেভেলপার, এক কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং এক গণিতবিদ দাবি করেন, তাঁরা নাকি সমাধান করে ফেলেছেন সংকেত সূত্রের! সমস্ত সংকেত একত্র করে নাকি দেখা যাচ্ছে, লেখা রয়েছে, ‘আমাকে খুঁজে বের করতে মজা পাচ্ছেন? আমি কিন্তু গ্যাস চেম্বারে ভয় পাই না। তা আসলে আমাকে স্বর্গের কাছাকাছিই নিয়ে যাবে। এই পৃথিবীতে আমি একাধিক ক্রীতদাস রেখে যাব। যারা আমার জন্য কাজ করবে।’
ছবি: প্রতীকী
এই বিষয়টি সামনে আসতেই অন্য একটা প্রশ্নও উঠে আসে। এমন সংকেত তো গত শতকের পাঁচের দশকে মার্কিন সেনাবাহিনী ব্যবহার করত। তাহলে কি জোডিয়াক কিলার আগে সেনাবাহিনীতে ছিল? বলাই বাহুল্য, এই উত্তরও মেলেনি। বরং 'ডার্টি হ্যারি'র মতো ছবি থেকে হাল আমলে নেটফ্লিক্সের তথ্যচিত্রে ভেসে বার বার আলোচনায় উঠে এসেছে জোডিয়াক কিলার। কিন্তু তার মুখ থেকে কুয়াশা সরানো যায়নি। হয়তো কখনও যাবেও না। পূর্বসূরি জ্যাক দ্য রিপারের মতোই সেও বোধহয় থেকে যাবে অধরাই।