বিশ্বদীপ দে: অন্ধকার রাত। ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়েছে এগারোটা। শহরে হয়তো একে তেমন রাত বলা চলে না। কিন্তু শহর থেকে দূরে এই পরিত্যক্ত এলাকায় এত রাতে জনমনিষ্যির দেখা পাওয়া ভার। এই রকম এক পরিবেশে যদি দেখা যায় মাঝরাস্তায় গাড়ির পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক দীর্ঘকায় ছায়া? এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছিল দুই মার্কিন দম্পতির। রজার ও লিন্ডা এবং স্টিভ ও মেরির। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় লিন্ডার মনে হয়েছিল, লোকটার পিছনে ভাঁজ করে রাখা একজোড়া লম্বা ডানা!
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, তেমন অন্ধকার জমিয়া ভূত হয়।’ কিন্তু ১৯৬৬ সালের সেই নভেম্বরে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার (West Virginia) পয়েন্ট প্লেজ্যান্ট নামের এক দুর্গম এলাকায় ওই দুই দম্পতি দেখেছিলেন কেমন করে অন্ধকার জমে জন্ম নিয়েছে এক বিকটদর্শন প্রাণী! গাড়ি সামনে এগোতেই যে একলাফে আকাশে উড়ে যায় ডানা মেলে। চলে যায় না কিন্তু। বলা যায় ধাওয়া করে দ্রুতবেগে ধাবমান গাড়িটিকে। লুকিং গ্লাসের ছায়ায় দেখা যায় তাকে। অতিকায় ছায়াশরীরে জ্বলজ্বল করছে একজোড়া লাল চোখ।
[আরও পড়ুন: ভারত থেকে পাঁচ হাজার লিটার বিষ কিনতে চায় অস্ট্রেলিয়া, কারণ জানলে অবাক হবেন]
ওই দম্পতিই প্রথম নন। এর তিন দিন আগে কবর খুঁড়তে আসা জনা পাঁচেক লোক দেখতে পেয়েছিল প্রাণীটিকে। কিন্তু রজার-লিন্ডা-স্টিভ-মেরির অভিজ্ঞতাই প্রথম সাড়া ফেলেছিল জনসমক্ষে। ওই দম্পতির অভিজ্ঞতা ফলাও করে ছেপেছিল যে কাগজ তার নাম ‘দ্য এথেন্স মেসেঞ্জার’। তারা খবরটার শিরোনাম করে ‘মনস্টার নো জোক ফর দোজ হু স ইট’। মনস্টার-অবিশ্বাসীদের নিপাট চিমটি যাকে বলে। যারা নিজের চোখে মনস্টারকে (Monster) দেখেছে তাদের কাছে কিন্তু ব্যাপারটা আর রসিকতা থাকে না। এরপর ক্রমশই বাড়তে থাকে প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা। খবরের কাগজে সেসব পড়ে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। মুখে মুখে নাম ছড়ায়। কেউ বলে পাখির মতো মানুষ। কারও বর্ণনায় ডানাওয়ালা মানুষ। কিন্তু ওহিও-র এক সংবাদপত্রের দেওয়া নামটাই জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল। মথম্যান (Mothman)।
আচমকাই এমন এক রহস্যের সন্ধান পেয়ে তোলপাড় হয়ে গেল গোটা পশ্চিম ভার্জিনিয়া। তবে আমেরিকা হয়ে সারা পৃথিবীতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল আরও কয়েক বছর পরে। সেকথা পরে। তার আগে বলা যাক, সেই ঘটনার কথা যা মথম্যানের মিথকে একটা অন্য মাত্রা দিল। ১৯৬৭ সালের সিলভার ব্রিজ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন ৪৬ জন। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গেল মথম্যান। কীভাবে? আসলে ওহিও নদীর উপরে এই সেতুটি পয়েন্ট প্লেজ্যান্টেই অবস্থিত। দুর্ঘটনার পরেই আর কোনও দাবির কথা শোনা গেল না মথম্যানকে চাক্ষুষ করার। ক্রমশ দৃঢ় হল ধারণা। ওই আশু ভয়াবহ দুর্ঘটনার সংকেত দিতেই হাজির হয়েছিল মথম্যান। সে আসলে মনস্টার নয়। বলা যায় এক মৃত্যুদূত। তার দীর্ঘ ডানার আড়ালে লুকনো রয়েছে মৃত্যু সংকেত।
পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ওই এলাকা এমনিতেই রোমাঞ্চের খনি। পয়েন্ট প্লেজ্যান্টে প্রথমবার যেখানে মথম্যানের দেখা মিলেছিল তার একদম কাছেই ‘টিএনটি এরিয়া’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পরিত্যক্ত সেই এলাকা। সেখানে পারমাণবিক গবেষণা চলত বলে জানা যায়। ওই অঞ্চলের অদূরে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু পরিবার বাস করলেও বাকি এলাকা ফাঁকা ফাঁকা। রাতের অন্ধকার নেমে এলে তাই নানা রকম দৃশ্য এমনিই যেন গজিয়ে ওঠে চোখের সামনে। এর আগেও এখানে ইউএফও দেখার কথা ভেসে এসেছে। এমনকী পাঁচের দশকে ফ্ল্যাটউড মনস্টার নামের এক আজব প্রাণীকেও নাকি দেখা গিয়েছিল সেখানে। ফলে মথম্যানের জন্ম বোধহয় অবশ্যম্ভাবীই ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মথম্যান একটা শহরতলির স্থানীয় লোককথা হয়েই হয়তো রয়ে যেত। সে যে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল, আগেই বলেছি, তা আসলে এক ভদ্রলোকের সৌজন্যে।
[আরও পড়ুন: অন্য মেয়েকে বিয়ে করছে প্রেমিক, খবর পেয়ে বাড়িতে ‘কনেযাত্রী’ নিয়ে হাজির প্রেমিকা]
তিনি জন কিল। ভিনগ্রহের প্রাণী থেকে ভবিষ্যৎ থেকে আসা প্রাণী, এমনই বিবিধ বিষয়ে বই লেখার পর ১৯৭৫ সালে তিনি মথম্যানকে নিয়ে লিখলেন ‘দ্য মথম্যান প্রফেসিস’। ওই একটি বইতেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে মথম্যান হয়ে উঠল এক অমোঘ মিথ। প্রসঙ্গত, একই নামে ২০০২ সালে হলিউডে একটা জমকালো সিনেমাও হয়। রিচার্ড গের ও লরা লিনির মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাতে অভিনয় করেছিলেন। সেই ছবির সাফল্যও মথম্যানকে পপ কালচারের অঙ্গাঙ্গী অংশ করে তোলে।
যাই হোক, পরবর্তী সময়ে পৃথিবী বিখ্যাত কিছু দুর্ঘটনা ও হামলার আগেও মথম্যানকে দেখতে পাওয়ার দাবি শোনা গিয়েছে। ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনে চেরনোবিল পরমাণুশক্তি কেন্দ্রের দুর্ঘটনা, ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা (9/11), ২০০৭ সালে মিনাসোটা ব্রিজ দুর্ঘটনা, ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা দাইচি পরমাণুশক্তি কেন্দ্রের দুর্ঘটনা- বারবার ফিরে এসেছে মথম্যান প্রসঙ্গ। দাবি ওঠে, এই সব দুর্ঘটনার আগাম আঁচ দিতে নাকি এই সব এলাকার আকাশে ভেসে এসেছিল দীর্ঘাঙ্গী ডানাওয়ালা এক ছায়া।
যে কোনও মিথকে ঘিরেই গজিয়ে ওঠে ব্যবসা। ২০০২ সালে পয়েন্ট প্লেজ্যান্টে শুরু হয়ে যায় বার্ষিক মথম্যান ফেস্টিভ্যাল। প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ জড়ো হন সেখানে। ২০০৩ সালে ভাস্কর বব রিচের তৈরি মথম্যানের ধাতব মূর্তি ও ২০০৫ সালে মথম্যান মিউজিয়াম হয়ে ওঠে সেখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য। ২০২০ সালে অতিমারীর প্রকোপে বন্ধ থাকলে এবছর সেপ্টেম্বরে হবে উৎসব। মথম্যানের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলবেন ট্যুরিস্টরা।
মথম্যানকে কেন্দ্র করে এই ব্যবসা উৎসাহিত করে রেখেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। ২০১৬ সালে এক ফোটোগ্রাফার দাবি করেন তিনি মথম্যানকে দেখেছেন। গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে তারপর আকাশে উড়ে যায় সেটি। কেবল বলা নয়, দাবির সপক্ষে তিনি হাজির করেন তাঁর তোলা ছবি। তা নিয়ে বিতর্ক ঘনায়। সেই সময় স্থানীয় বাসিন্দা ক্যারোলিন হ্যারিস এক সংবাদমাধ্যমকে সটান জানিয়ে দেন, ‘‘কে বলল মিথ্যে? আমি হলফ করে বলতে পারি মথম্যান আছে। লোকে যতই খারাপ বলুক, ও খুব ভাল। হাজার হোক, ওর জন্যই প্রতি বছর এত লোক আসে এখানে।’’
অন্যান্য অতিপ্রাকৃত ঘটনার মতোই মথম্যানের অস্তিত্বের ব্যাখ্যাও করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যা দু’টির একটি হল, স্যান্ডহিল ক্রেন। লম্বা চেহারার এই পাখিকে অন্ধকারে মানুষ বলে ভুল করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিংবা প্যাঁচা। বিশেষ করে মথম্যানের আতঙ্কঘন লাল চোখ সেদিকেই যেন ইঙ্গিত করছে। কেউ কেউ আবার অতি উৎসাহে দাবি করেছেন, পরিত্যক্ত ‘টিনএনটি এরিয়া’র সৌজন্যে মিউটেশনের চক্করে পড়ে স্যান্ডহিল ওই রকম চেহারা ধারণ করেছে।
এবং গণ-হিস্টিরিয়া। মথম্যানের দৌরাত্ম্যের অন্যতম ক্যাটালিস্ট। বলা হয়, স্যান্ডহিল ক্রেন কিংবা কোনও প্যাঁচা থেকে একবার জন্ম নেওয়ার পর ক্রমশ দানা বেঁধে মথম্যানের এমন জমাটি রূপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া গল্পগাথায়। তেমনটাই তো হয়। কলাগাছের ছায়াকে যেভাবে প্রেতচ্ছায়া বলে মনে হয়। আসলে মানুষের মনের মধ্যে থাকে রোমাঞ্চের প্রতি অদম্য আকর্ষণ। সেই আকর্ষণই পূরণ করে নেয় গল্পের সব ফাঁকফোকড়। তৈরি হয় নিটোল মিথ। কেবল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর রুকুই নয়। আমরা সকলেই বিশ্বাস করতে চাই, সব সত্যি। অরণ্যদেব সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, ডাকু গন্ডারিয়া সত্যি। এবং মথম্যান, সেও সত্যি।