গৌতম ব্রহ্ম: জেলে গিয়ে ঘানি টানা, বাক্যটা প্রবাদে পরিণত হয়েছে। কারণ, একটা সময় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের দিয়ে ঘানি টানিয়ে সরষে পিষে খাঁটি তেল বার করা হত বিভিন্ন কারাগারে। কালের প্রবাহে কারাগার এখন সংশোধনাগার। কিন্তু ঘানিতে সরষের তেল ভাঙানোর প্রথা এখনও মজুত বেশ কয়েকটি জেলে। এবার সেই জেলের ঘানির তেল বিক্রি হবে খোলাবাজারে। দাম অবশ্য একটু বেশিই পড়বে, লিটারপিছু ২৪৫ টাকা। কলকাতায় জেসপ বিল্ডিংয়ের পাশে একটা দোকান নেওয়া হচ্ছে, কয়েদিদের হাতে তৈরি ‘কাচ্চি ঘানি’ সরষের তেল সেখান থেকেই বিকোবে বলে জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের কারামন্ত্রী অখিল গিরি।
ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অভিনব। কারাবন্দিদের হাতে টানা ঘানির তেল রীতিমতো ‘ব্র্যান্ডিং’ করে খোলাবাজারে বিক্রির ভাবনাটা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে বলে সরকারি ও বাণিজ্যিক মহল মনে করছে। কিছুদিন আগে কারা দপ্তরের তরফে রাজ্যের মন্ত্রীদের উপহার দেওয়া হয়েছে কয়েদিদের তৈরি হরেক সামগ্রী। তার রেশ থাকতেই কারামন্ত্রী নয়া উদ্যোগটির খবর শুনিয়েছেন। তিনি জানান, প্রেসিডেন্সি, দমদম, মেদিনীপুর ও জলপাইগুড়ি সংশোধনাগারে ঘানি রয়েছে। জেলে তৈরি তেলের বেশিটা জেলেই ব্যবহার হয়। উদ্বৃত্ত তেল এবার বাজারজাত করা হবে। কারা সূত্রের খবর, রাজ্যের বিভিন্ন জেলের ঘানি মিলিয়ে রোজ মোটামুটি এক টন সরষের তেল উৎপাদিত হয়। যার একাংশ ‘কাচ্চি ঘানি’ লেবেলিং হয়ে বাজারে চলে আসবে। জেলের এক আধিকারিকের দাবি, আগে কয়েদিরা ঘানি টেনে সরষে থেকে তেল বার করলেও এখন ঘানি বিদ্যুৎচালিত। যদিও কিছু কাজ কয়েদিদের ‘ম্যানুয়ালি’ করতে হয়। জেলের মধ্যে সরষে চাষ হয়, সেই সরষেই ভাঙানো হত ঘানিতে। এখন তেল ভাঙানোর জন্য বাইরে থেকেও টেন্ডার করে সরষে কেনা হয়। সংশোধনাগারের কিছু আবাসিকের তেলকল চালানোর প্রশিক্ষণ রয়েছে, তাঁরা বাকিদের তালিম দেন।
[আরও পড়ুন: বিপ্লবের আঁতুড়ঘরেই আক্রান্ত লেনিন! নকশালবাড়িতে মূর্তি ভাঙা নিয়ে চাপানউতোর]
তিহার জেলের কয়েদিদের তৈরি নানা জিনিস ইতিমধ্যেই ব্র্যান্ডিং হয়ে বাজারে এসেছে। সেখানে বেসরকারি সহযোগিতায় কাপড়, মশলাপাতি, জুতো ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। তিহারে রোজ ঘড়ি ধরে সকাল ন’টায় ফ্যাক্টরির কাজ শুরু হয়। পুরনো হিন্দি গানের তালে তালে কয়েদিরা কাজ করেন। তিহারের আসবাবের খ্যাতি যথেষ্ট, ইদানীং কাগজও তৈরি হয়। সেই কাগজ থেকে ফাইলকভার বানিয়ে স্ট্যাম্প মেরে বিক্রি হয়। তিহারে একটা জনপ্রিয় বেকারি বিভাগও রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গও পিছিয়ে নেই। এ রাজ্যের জেলগুলোয় আবাসিকদের দিয়ে হরেক কাজ করানো হয়। তিহারের ধাঁচে সেগুলি ব্র্যান্ডিং করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পণ্য বিপণনের দায়িত্ব নিচ্ছে। নানা ধরনের প্রশিক্ষণ চলছে। দমদম জেলে পাটের ব্যাগ, দোলনা, চাদর বানান আবাসিকরা। অনেকেই মুক্তির পরে জেলের ট্রেনিং কাজে লাগিয়ে নতুন জীবন শুরু করেন। তিহারে কর্মরত আবাসিকদের আয়ের ২৫ শতাংশ একটি কল্যাণমূলক তহবিলে জমা হয়, যেখান থেকে বন্দিদের পরিবারে আর্থিক সাহায্য পাঠানো হয়৷ আয়ের বাকি অংশ থেকে আবাসিকরা দৈনন্দিন খরচাপাতি চালান। বঙ্গের জেলাখানাগুলিতেও এমন কল্যাণমূলক দর্শন মেনেই কাজ হয় বলে জানিয়েছেন অখিলবাবু।