বিশ্বদীপ দে: নয়ের দশকের সেই তোলপাড় ফেলে দেওয়া ‘রোজা’ ছবিটা মনে পড়ে? ধাবমান ক্যামেরার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুখোশধারী জঙ্গিদের কঠোর পাহারা পেরিয়ে দর্শককে একটু একটু করে গোপন জঙ্গি ডেরায় নিয়ে গিয়েছিলেন পরিচালক। ‘জঙ্গি’ (Terrorist) শব্দটার সঙ্গে গোপনীয়তার এই অনায়াস সংযোগকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সর্বদাই তা যেন ছায়াঘেরা এক প্রেতসুলভ অস্তিত্ব। আচমকাই হানা দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে মানুষের বেঁচে থাকার অমূল্য আয়াসকে।
কিন্তু ঘরের পাশেই আরশি নগর পাকিস্তানে (Pakistan) ছবিটা একেবারেই আলাদা। সেখানে ঝকঝকে রোদ্দুরের মতোই স্পষ্ট জেহাদিদের দিন গুজরান। নাহলে কি আর দিনের পর দিন হবু জঙ্গিদের এভাবে ‘তৈরি’ করতে পারত দারুল উলুম হাক্কানিয়া (Darul Uloom Haqqania), এক কথায় যাকে সবাই চেনে ‘জেহাদ বিশ্ববিদ্যালয়’ (University Of Jihad) নামে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অন্যতম ‘কৃতী’ ছাত্র মোল্লা ওমর। হ্যাঁ, সেই ওমর, আমেরিকা যার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল ১ কোটি ডলার। রুশদের সঙ্গে লড়াই করার সময়ে নষ্ট হয়েছিল একটা চোখ। উড়ে গিয়েছিল এক হাতের কবজি। তাই নিয়েই লাদেন-ঘনিষ্ঠ ওমর তালিবানদের আফগানিস্তান দখলের প্রধানতম কারিগর হয়ে ওঠে। এহেন ওমরের ‘গুরু’ ছিলেন মাদ্রাসার প্রাক্তন চ্যান্সেলর সামি-উল-হক৷ অধুনাপ্রয়াত সামি আবার ‘তালিবানের পিতা’ হিসেবে খ্যাত ছিলেন পাকিস্তানে। সুতরাং হাক্কানিয়ার জঙ্গি-যোগের বিষয়টি এখানেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
[আরও পড়ুন: কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে মার পুলিশের, ফ্লয়েড কাণ্ডের স্মৃতি উসকে বিক্ষোভে উত্তাল ফ্রান্স]
যাই হোক, ওমর শেষ পর্যন্ত হিমশৈলের চূড়ামাত্র। এই মাদ্রাসা ফেরত আরও কয়েকটি ‘উজ্জ্বল’ নাম হল হাক্কানি নেটওয়ার্কের মূল হোতা জালালউদ্দিন হাক্কানি, কিংবা ২০০৭ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর দুই হত্যাকারী। তবে শেষোক্তদের নিজেদের পড়ুয়া বলে মেনে নেয় না হাক্কানিয়া। বছরের পর বছর এই মাদ্রাসার প্রাক্তনীরা গিয়ে ভিড়েছে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীতে। পাশাপাশি রাশিয়া কিংবা আমেরিকার সঙ্গে আফগানদের সংঘর্ষের সময়ও তাদের দেখা গিয়েছে যুদ্ধে যোগ দিতে। মাদ্রাসার এক শিক্ষক মৌলানা ইউসুফ শাহ এই সব প্রসঙ্গ উঠলে চওড়া হাসি হেসে বলেন, ‘‘আমরা গর্বিত!’’
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের এই ‘জেহাদ বিশ্ববিদ্যালয়’ পেশোয়ার থেকে ৬০ কিমি দূরে অবস্থিত। রাজধানী ইসলামাবাদ থেকেও দূরত্ব বেশি নয়। ৯০ কিমি। এখানে পড়াশোনা করে প্রায় হাজার চারেক ছাত্র। মাদ্রাসা থেকেই শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া ও পোশাক-পরিচ্ছদের খরচ দেওয়া হয়৷ ঠিক কী হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই মাদ্রাসায়? একটা কথা পরিষ্কার করে দেওয়া ভাল। এখানে কিন্তু কোনও জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির নেই। মুখে কালো কাপড় বেঁধে অস্ত্র হাতে মহড়ার ছবি মাথায় ভেসে উঠে থাকলে তা মুছে ফেলুন। এখানে কাজ হয় আরও গভীরে।
[আরও পড়ুন: চাপে চিন! ভারত–মালদ্বীপ–শ্রীলঙ্কার ত্রিদেশীয় বৈঠকে যোগ দিতে কলম্বোয় পৌঁছলেন দোভাল]
একজন সাধারণ মানুষকে ‘খুনি রোবট’-সুলভ জঙ্গি হিসেবে গড়ে তুলতে গেলে সবার আগে দরকার তার মগজটার দখল নেওয়া। অভিযোগ, সেই কাজটাই হয় এখানে। ধীরে ধীরে পড়ুয়াদের মাথার মধ্যে ভরে দেওয়া হতে থাকে জেহাদের বীজ। ছাত্ররা চাইলে ছুটির সময়ে জেহাদে অংশগ্রহণের জন্য যেতে পারে! তবে শিক্ষার্থীদের সাফ কথা, তাদের মোটেই জেহাদে যেতে কেউ উৎসাহ দেয় না। তবে এখানে জেহাদ নিয়ে খোলাখুলি আলাপ-আলোচনা চলে নিরন্তর। আয়ারল্যান্ডের কুইন বিশ্ববিদ্যালয়ের আফগান-পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ মাইকেল সেম্পলের কথায়, ‘‘ফ্যাকাল্টি, পড়ুয়া ও প্রাক্তনীদের সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো যোগসূত্র রয়েছে আফগান তালিবানদের সঙ্গে। তারা নিয়মিত এখানকার তরুণ স্নাতকদের নিয়োগ করে তাদের গোষ্ঠীতে। আর সবচেয়ে বড় কথা, এসব মোটেও গোপনে হয় না। যেভাবে রিক্রুটমেন্ট ফেয়ারে প্রযুক্তি সংস্থাগুলো তাদের কর্মীদের নির্বাচন করে, ব্যাপারটা সেভাবেই ঘটে।’’
অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। খোদ পাক সরকার নাকি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মোটা অঙ্কের অনুদান দেয়। অভিযোগ, ২০১৭ সালে ইমরান খানের দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ ক্ষমতায় আসার আগেই প্রায় ২৭ লক্ষ ডলারের অনুদান পাইয়ে দেয় ‘জেহাদ বিশ্ববিদ্যালয়’-কে । আগের সরকারও দিয়েছে। এর থেকেই পরিস্থিতিটা বোঝা যায়। রাষ্ট্রের মদত থাকলে আর গোপনীয়তা কীসের? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের স্বাধীনতার সমবয়সি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফুলেফেঁপে ওঠা শুরু গত শতকের আটের দশকে। এই ২০২০ সালের অতিমারীর সময়ও মাস্ক, সামাজিক দূরত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিয়মিত ক্লাস চলছে এখানে। বিরাট হলঘর উপচে অতিরিক্ত পড়ুয়াদের বসাতে হচ্ছে ব্যালকনিতেও!
সুতরাং পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই। ২০১৪ সালের পেশোয়ারে স্কুলের মধ্যে নারকীয় সেই হত্যালীলা মনে পড়ে? দেড়শোরও বেশি মারা গিয়েছিল। তাদের মধ্যে ১৩৪ জনই তাজা ফুলের মতো ছোট্ট পড়ুয়ারা! তারপর জঙ্গি ক্রিয়াকলাপ দমনে জাতীয় কর্মসূচি নিয়েছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু ছ’বছর কেটে গিয়েছে। কিছুই হয়নি। নিয়মিত সরকারি অনুদান পেয়েছে হাক্কানিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানগুলি।
আন্তর্জাতিক আর্থিক দুর্নীতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফএটিএফের (FATF) ধূসর তালিকায় ঢুকে পড়তে হয়েছে পাকিস্তানকে। সন্ত্রাসে আর্থিক মদত দেওয়ার অভিযোগই তাদের সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্তির প্রধান কারণ। আপাতত সেই তালিকা থেকে বেরতে মরিয়া ইসলামাবাদ। এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি শীর্ষ পাক গোয়েন্দা সংস্থা FIA দেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গিদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ২৬/১১ মুম্বই হামলার মূলচক্রী হাফিজ সইদের ১০ বছরের সাজাও ঘোষিত হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, এইভাবে কোণঠাসা পাকিস্তান বোঝাতে চাইছে তারা জঙ্গি দমনে কতটা তৎপর। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ধূসর তালিকা থেকে বেরবে কিনা সে উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের ধূসর ছায়া যে এখনও তাদের ঢেকে রেখেছে ‘জেহাদ বিশ্ববিদ্যালয়’-এর অস্তিত্ব যেন সেকথাই বুঝিয়ে দেয়।