নব্যেন্দু হাজরা: বাবু, তুই ভাল আছিস? কেউ ডিসটার্ব করছে না তো! রাতে ঘরের দরজা ভাল করে দিয়ে ঘুমাবি। বাইরে কেউ ডাকলেও যাবি না। আগে আমায় ফোন করবি।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই একই কথা দিনে অন্তত দশবার করে ছেলেকে বলছেন সোদপুরের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষিকা সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়। একমাত্র ছেলেকে বিবিএ পড়তে সদ্য বেঙ্গালুরুতে পাঠিয়েছেন। একমাত্র ছেলেকে ছেড়ে থাকার চিন্তা তো রয়েইছে। কিন্তু যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা যেন সব হিসাব ওলট-পালট করে দিয়েছে তাঁর। টেনশনে ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমোতে পারছেন না। কোনও কাজে মন নেই। “বারবার আমার মুখে একই কথা শুনে বিরক্ত ছেলেও। কিন্তু তবু মায়ের মন তো!” চোখের কোনায় জল মুছতে মুছতে বৃহস্পতিবার সন্ধেয় কথাগুলো বলছিলেন সুতপাদেবী। তাঁর মতোই অবস্থা এই শহরের অজস্র মায়েদের। যাদের কারও ছেলে বেঙ্গালুরুতে বিবিএ পড়তে গিয়েছে। কারও ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং। কারও মেয়ে আবার জেলা থেকে শহরের নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়েছে ফাইন আর্টস নিয়ে পড়ার জন্য। কারও ছেলে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলজীবন বেছেছে ডাক্তারি পড়তে। এতদিন তো ঠিকই ছিল। কিন্তু যাদবপুরের প্রথম বর্ষের পড়ুয়ার হস্টেল জীবনের এমন ভয়াবহ পরিণতিতে এই ছেলে-মেয়েগুলোর অভিভাবকরা প্রত্যেকেই এখন আতঙ্কিত। তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে খারাপ কিছু হচ্ছে না তো! এই দুশ্চিন্তাই তাড়া করে বেড়াচ্ছে সকলকে।
[আরও পড়ুন: ফের রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাত, যাদবপুরে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য]
স্কুল থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেল, সর্বত্রই সিনিয়রদের তথাকথিত দাদাগিরি চিরকালই হয়ে আসছে। তবে সেটা তো একটু ধমকানো, চমকানোতেই আবদ্ধ থাকত। এমন প্রাণঘাতী হত না। বলছিলেন রাজ্যের এক আমলাও। তাঁর কথায়, “আমার ছেলেও ভিনরাজ্যের এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ে। এই ঘটনায় একটু যে চিন্তা হয়নি, তা নয়। তবে ছেলে বলল, ওখানে তেমন কিছু হয় না।” যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের একাংশ। অনেকেই বলছেন, এখন তো ছেলেমেয়েকে হস্টেলে রেখে পড়ানোটাই আতঙ্কের। দূরে থাকলে দুশ্চিন্তা মনে এমনিতেই ভর করে। তার উপর যদি এভাবে কোনও মায়ের কোল খালি হতে দেখা যায়, তার থেকে বেদনাদায়ক তো কিছু নেই। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রত্যেকেই চান, সেরা জায়গায় তাঁর ছেলেমেয়ে পড়ুক। তাই গ্রাম থেকে শহরে, আবার শহর থেকে ভিনরাজ্যে তাঁদের পড়তে পাঠান অভিভাবকরা। কেউ সরকারি, আবার সেখানে সুযোগ না পেলে, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, এমবিএ, বিবিএ, হোটেল ম্যানেজমেন্ট-বা অন্য যে কোনও উচ্চশিক্ষার জন্য বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি করান তাঁরা। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে বাজি ধরেন বাবা-মা। অথচ তার পরিণতি নিয়েই এখন শঙ্কিত অনেকে। দূরে থাকা ছেলেমেয়ে কেমন পড়াশোনা করছে, ঠিকমতো খাচ্ছে কি না এসবের থেকেও এখন বাবা-মার বড় চিন্তা হয়েছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের সিনিয়ররা কেমন? সন্তানদের উপর র্যাগিং হচ্ছে কি না সেই সব।
মনোবিদ দোলা মজুমদারের কথায়, মায়ের মন, চিন্তা তো হবেই। তবে আমি যতদূর জানি, রাজ্যের বাইরে র্যাগিং কম হয়। আমার মেয়েও মাদুরাইতে পড়ে। সাউথে র্যাগিং হয় না প্রায়। জুনিয়রদের সঙ্গে সিনিয়রদের হস্টেল আলাদা থাকে। এখন তো মনে হয় এরাজ্যের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ে সরকারের একটু কড়া হওয়া উচিত। তিনি বলেন, “এই ঘটনার পর আমিও আমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছি যে, তুই তো তামিল জানিস না। সেটা নিয়ে কেউ কিছু বলে না, বা কোনও র্যাগিং হয় না তো! ও বলেছে, না।”