স্টাফ রিপোর্টার: ‘ঘনিষ্ঠ বান্ধবী’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের (Arpita Mukherjee) সঙ্গে তাঁর যৌথ সম্পত্তির একাধিক ঠিকানায় খানাতল্লাশির মাঝেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেপ্তার পর্বে এবার নাটকীয় মোড়। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে ধরা পড়লেও মন্ত্রিত্ব যে তিনি ছাড়বেন না, গ্রেপ্তারের পাঁচদিনের মাথায় বুধবার পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজেই তা জানিয়ে দিয়েছেন। এখনও খাতায়-কলমে রাজ্যের শিল্প-সহ তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিষদীয় দফতরের মন্ত্রী তিনি। বৃহস্পতিবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে পার্থর দপ্তর অন্য মন্ত্রীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিল্প দপ্তরটি মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতেই রাখতে পারেন।
এদিকে, অবিলম্বে পার্থর পদত্যাগের দাবিতে রাজ্যজুড়ে সরব বিরোধীরা। তবে আইনি প্রক্রিয়ার দিকে নজর রেখে এবং প্রবীণ এই নেতার প্রতি সৌজন্যের খাতিরেই সম্ভবত দলের তরফে এই মর্মে এখনও কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা না করেই এবার পার্থর খুল্লমখুল্লা বার্তা, মন্ত্রিত্ব ছাড়তে তিনি নারাজ। যদিও পার্থর এই বার্তা তাঁর নিজের জন্যই ‘আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত’ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছে আইনজীবী মহল। রাজ্যের শীর্ষ আদালতে ইতিমধ্যেই প্রভাবশালী বলে চিহ্নিত হয়েছেন মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব। তাঁর সম্পর্কে ওই পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহারের আরজিও খারিজ হয়েছে হাই কোর্টে। সেক্ষেত্রে মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা না দিলে ওই প্রভাবশালী তকমাই ইডির তদন্ত তথা আইনি প্রক্রিয়ায় পার্থবাবুর বিরুদ্ধে যাবে বলে আইনজীবীরা মনে করছেন। সূত্রের খবর, তাঁর নিজের স্বার্থেই যে প্রভাবশালী তকমা অবিলম্বে ঝেড়ে ফেলা জরুরি, ঘনিষ্ঠ আইনজীবীরা তা ইতিমধ্যেই পার্থবাবুকে ঠারেঠোরে বোঝানোর চেষ্টাও শুরু করেছেন।
[আরও পড়ুন: রাজ্যের ২০ হাজার অস্থায়ী পদে নিয়োগেও দুর্নীতি! কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ চাকরিপ্রার্থীরা]
বুধবার সকালে ইডি হেফাজতে থাকা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে শারীরিক পরীক্ষার জন্য জোকার ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে ঢোকার মুখেই সাংবাদিকরা পার্থকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেবেন? জবাবের বদলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় পালটা প্রশ্ন ছুড়ে জানতে চান, “কী কারণে?” শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পরও এদিন ইস্তফা প্রসঙ্গে পার্থর ওই পালটা প্রশ্ন ঘিরে তোলপাড় তুঙ্গে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতকিছুর পরও ইস্তফা দেওয়ার কথাই যে তিনি ভাবছেন না, ওই মন্তব্যের মাধ্যমে পার্থ এদিন কার্যত সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ওই মনোভাব তাঁর নিজের স্বার্থেই বিপজ্জনক বলে মনে করছে আইনজীবীমহল। তাঁদের যুক্তি, এসএসকেএমে (SSKM) চিকিৎসাধীন থাকলে প্রভাবশালী হিসাবে তদন্ত প্রভাবিত করতে পারেন বলে মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ইতিমধ্যেই হাই কোর্টের শুনানিতে কাঠগড়ায় তুলেছে ইডি (ED)। তারই ভিত্তিতে প্রভাবশালীদের প্রসঙ্গ টেনে নিজস্ব পর্যবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট বিচারপতি গুরুতর মন্তব্যও করেন। পরবর্তীকালে ওই মন্তব্য প্রত্যাহারের জন্য পার্থবাবুর তরফে আবেদন জানানো হলেও আদালত তা খারিজ করে দেয়। কাজেই মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা না দিলে ওই প্রভাবশালী তকমাই পার্থর বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় তদন্তকারী সংস্থার তরফে ব্যবহার করার সম্ভাবনা প্রবল।
[আরও পড়ুন: মরণোত্তর চক্ষুদান করলেন শহরের ১৫ দৃষ্টিহীন, আলো ফিরবে অনেকের চোখে]
অতীতের বিভিন্ন হাই প্রোফাইল মামলার নজির টেনে দুঁদে আইনজীবীদের আরও বক্তব্য, প্রভাবশালী হওয়ায় তদন্ত প্রভাবিত করতে পারেন বলে যুক্তি দেখিয়ে বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার তরফে সাধারণত হেভিওয়েটদের জামিনের বিরোধিতা করা হয়ে থাকে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee) এখনও তিন তিনটি দপ্তরের মন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রভাবশালী তকমা এক্ষেত্রেও তাঁর জামিনের অন্তরায় হয়ে উঠতেই পারে। এই নিরিখে মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা কার্যত পার্থবাবুর পক্ষে ইতিবাচক হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করছে সংশ্লিষ্ট ওই আইনজীবীমহল।
এদিকে মন্ত্রিসভা থেকে পার্থকে বরখাস্তের দাবি নিয়ে পথে নামেন বাম নেতা-কর্মীরা। পার্থকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণের দাবি নিয়ে বুধবার বিকেলে রাজ্যপাল লা গণেশনের সঙ্গে দেখা করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। পার্থবাবুকে মন্ত্রিসভা থেকে অবিলম্বে সরাতে মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে তিনি রাজ্যপালকে আবেদন জানান। এই প্রসঙ্গে অবশ্য বিরোধী দলনেতাকে পালটা নিশানা করেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh)। তাঁর কথায়, “রাজ্যের তথাকথিত বিরোধী দলনেতা রাজ্যপালের কাছে গিয়েছেন, বলার কিছু নেই। বরং সিবিআইকে নির্দেশ দিন, একই মামলায় অনেকের বাড়িতে যাবে আর শুভেন্দু (Suvendu Adhikari) বসে থাকবে, সেটা হতে পারে না।” পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে পেশ করা তথ্যে আদালত মান্যতা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ইতিমধ্যেই তৃণমূলের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ইডির তরফে তদন্তে নিত্যনতুন তথ্য উঠে আসার মাঝেই বুধবার পার্থবাবু যেভাবে মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা না দেওয়ার বার্তা দিয়েছেন, তাতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা আইনজীবীরাও অশনি সংকেত দেখছেন বলে খবর। হাই কোর্টে পার্থর বিরুদ্ধে প্রভাবশালী তত্ত্ব খারিজ করার আবেদন জানিয়ে ইতিমধ্যেই তাঁদের খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। পরিষদীয় মন্ত্রী হিসাবে পার্থবাবু যে গাড়ি ব্যবহার করতেন, মঙ্গলবার তাঁর তরফে সেই গাড়ি বিধানসভায় ফিরিয়ে দেওয়ার পর তাঁর ইস্তফা নিয়ে প্রবল জল্পনা দানা বাঁধে। কিন্তু বুধবার তিনি নিজেই সেই জল্পনায় জল ঢেলে দেওয়ার পর ওই আইনজীবীরাও নড়েচড়ে বসেছেন বলে জানা গিয়েছে। মন্ত্রিত্ব ছাড়লে প্রভাবশালী তকমা আর কোনওভাবেই তদন্তকারী সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না বলে পার্থবাবুকে ওই আইনজীবীরা বোঝানো শুরু করেছেন বলে জানা গিয়েছে। সেক্ষেত্রে ওই ইস্তফা আইনি লড়াইয়ে পার্থবাবুর পক্ষে সহায়কও হয়ে উঠতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীমহলের ধারণা।