কৃশানু মজুমদার: ”ও তুমিই নাম্বার ১৪। তুমি তো আমাকে খেলতেই দিলে না।” স্বয়ং ফুটবল-সম্রাট পেলে এই কথাগুলো বলেছিলেন গৌতম সরকারকে (Gautam Sarkar)। ব্রাজিলীয় কিংবদন্তির এই প্রশংসাসূচক কথাগুলো এখনও যেন শুনতে পান মাঝমাঠের ব্রিগেডিয়ার। দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে ১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের মোহনবাগান-কসমস (Mohun Bagan vs Cosmos) ম্যাচের স্মৃতি। পেলের (Pele) পা থেকে বল কেড়ে নিচ্ছেন ১৪ নম্বর জার্সিধারী গৌতম। তাঁর উপরই তো পেলেকে নজরে রাখার গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন মোহনবাগানের তৎকালীন কোচ পিকে ব্যানার্জি (PK Bannerjee)।
বর্ষশেষের মুখে হৃদয়বিদারক খবরে কম্পমান ফুটবলবিশ্ব। শোকের ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে ফুটবল-মক্কার বেলাভূমিতেও। সেই কবে ১৯৭৭ সালে কসমস ক্লাবের হয়ে বিখ্যাত ১০ নম্বর জার্সিধারী খেলতে এসেছিলেন বাঙালির বড় আপন, বড় প্রিয় ইডেন উদ্যানে। পেলেকে একবার দেখার জন্য জনতার ঢল নেমেছিল বিমানবন্দরে। তাঁর আগে কোনও রাষ্ট্রপ্রধানকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এমন ভিড় দেখা যায়নি। সেই বিশাল সংখ্যক ফুটবলপ্রেমীর উন্মাদনা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে যান পেলে। স্মৃতিরোমন্থন করে গৌতম সরকার সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে বলছিলেন, ”পেলে আসবেন, এ কথা অনেক আগে থেকেই আমাদের বলছিলেন ধীরেনদা (দে)। প্রথমটায় আমরা বিশ্বাসই করিনি। ধীরেনদা আমাদের বলতেন, বিশ্বাস করছ না তো। সবাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছিল। সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল। আমি বলব, পেলেকে কলকাতায় আনার পুরো কৃতিত্বই ধীরেনদার।”
[আরও পড়ুন: সত্যিই কি একে অপরকে শত্রু ভাবতেন! কেমন ছিল পেলে-মারাদোনার রসায়ন]
টোকিও থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে দমদম বিমানবন্দরে পা রেখেছিলেন পেলে। কলকাতা আসার আগে দু’ সপ্তাহের শুভেচ্ছাসফরে কসমস ক্লাব খেলেছিল জাপান, চিনে। সেখানকার দলগুলোকে হারিয়ে এই শহরে পা রেখেছিল কসমস। কিন্তু মোহনবাগান বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল পেলের দলকে। স্মৃতির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে গৌতম সরকার বলছেন, ”পেলেকে ছোঁয়া, দেখার বাসনা সবার থাকে। আমারও ছিল। কিন্তু মাঠে পেলেই ছিলেন আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। পেলের তুলনায় আমি যত ক্ষুদ্রই হই না কেন, ওঁকে মার্কিং করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমার উপরে। আমি, সুব্রত ভট্টাচার্য, সুধীর কর্মকার, প্রদীপ চৌধুরী মিলে সফল হয়েছিলাম পেলেকে থামাতে। সফল বলছি এই কারণে যে ম্যাচের রেজাল্ট হয়েছিল ২-২।”
পেলের প্রয়াণের পরে বিবিসি-তে ফুটবল-সম্রাটের কলকাতা সফর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে এক জ্যোতিষী আগেই জানিয়েছিলেন, পেলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। পুরো সময় খেলতে পারবেন না। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎদ্রষ্টার কথা ভুল প্রমাণিত করে ফুটবলসম্রাট পুরো সময় মাঠে ছিলেন। গৌতম সরকার বলছিলেন, ”ম্যাচের আগে ধীরেনদা বলেছিলেন দশ-বারো গোল খেও না। আমার সঙ্গে হাবিব ছিল। ধীরেনদাকে বলেছিলাম, দশ-বারো গোল খেলে আর ফুটবল খেলব না। মাঠ ছিল ভিজে। পেলেকে খেলতে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু কারও কথা শোনেননি পেলে। নেমে পড়েছিলেন মাঠে। তার পরের ঘটনা আমাদের আরও অভিভূত করে দিয়েছিল।”
কী সেই ঘটনা? মাঝমাঠের প্রাণভোমরা বলছিলেন, ”পেলে আমাদের খেলায় অভিভূত হয়ে উপহার দিয়েছিলেন। পেলেকে বলা হয়েছিল এশিয়া সফরকালে যে দলকে সেরা বলে মনে হবে সেই দলকে নিখরচায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশে খেলার জন্য পাঠানো হবে। পেলেই আমাদের কথা বলেছিলেন স্পনসরকে। ১৯৭৮ সালে আমরা গিয়েছিলাম সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকংয়ে। এটা আমাদের বিরাট পাওনা।”
পেলেকে মাঠে বিপজ্জনক হতে দেননি গৌতম সরকার। ফুটবল-সম্রাটের পা থেকে বল কাড়ছেন, এই ছবি বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে এখন। সেই ছবি রয়েছে কসমস ক্লাবের ২৭ তলার ঘরেও। তা নিয়ে প্রতিবেদন লেখা হয়েছিল একটি বাংলা দৈনিকে। শিরোনাম হয়েছিল, ‘পেলেকে তাড়া করে চলেছেন গৌতম।’ একমাত্র ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে তাঁর ছবি রয়েছে কসমস ক্লাবে।
পেলের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ফুটবলসমাজ। সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে যাচ্ছে। গৌতম সরকার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, ”পেলে নিজেই ফুটবলের এক প্রতিষ্ঠান। ওঁর বল ধরা, টার্নিং পাসিং, ভলি মারা সবই উল্লেখযোগ্য। ভাষায় প্রকাশ করা তা সম্ভব নয়।”
পরশপাথরের ছোঁয়া একদিন পেয়েছিলেন। সেই স্পর্শে হৃদয় যেন আজও সোনালি হয়ে রয়েছে। স্মৃতিচারণার সময়ে মনে হয় গতকালের ঘটনা। আবেগপ্রবণ গৌতমের মনে পড়ে যায় ফুটবলসম্রাটের কাছ থেকে পাওয়া অমোঘ স্বীকৃতির কথা। যা শুনে চুনী গোস্বামীর মতো কিংবদন্তির সরস উক্তি, ”এমন কমপ্লিমেন্টের পর তোর আর ফুটবল খেলার দরকার নেই।” সত্যিই তো। স্বয়ং পেলে যখন অনুরাগী হয়ে ওঠেন, তখন ফুটবলারের প্রাপ্তির ভাঁড়ার পূর্ণ হয়ে ওঠে। পেরিয়ে গিয়েছে সাড়ে চার দশক। আজও সেই প্রাপ্তি রয়ে গিয়েছে তাঁর জীবনের স্মারক হয়ে।
[আরও পড়ুন: ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখে ঋষভ পন্থের গাড়ি, মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ক্রিকেটার]