সাইবার অপরাধের পরিসরে ব্যাংকিং ক্ষেত্রও পড়ে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, ব্যাংক তথা অন্য আর্থিক পরিষেবাক্ষেত্রে সাইবার অপরাধের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। গ্রাহকরা কীভাবে বিপদের আঁচ করতে পারবেন, কীভাবেই বা সাবধান হবেন, জানালেন নীলাঞ্জন দে
সাইবার ক্রাইম আজকাল জলভাত – বিনিয়োগের রাস্তায় অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু ধরনের ‘ফ্রড’ তথা প্রতারণা, সোজা বাংলায় লোক-ঠকানো, ইদানীং মার্কেটের পরিসরে ক্রমাগত হয়ে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই, লগ্নিকারীকে খুব সাবধানে থাকতে হবে, এবং তিনি যাতে সাইবার ক্রিমিনালদের শিকার না হয়ে পড়েন সেজন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। এই বিষয়েই আজ আমাদের কিছু জরুরি কথা।
ব্যাংক তথা অন্য ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস সংক্রান্ত পরিষেবার বিস্তৃত ক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইম বেড়েই চলেছে। গ্রাহকগণ বহুবার ঠকেছেন, নাস্তানাবুদ হয়েছেন, আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। দুর্বৃত্তরা নতুন উপায় বার করতে সর্বদাই সিদ্ধহস্ত, এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই সাধারণ ঋণই নিন বা সামান্য ব্রোকিং সার্ভিসেসই ব্যবহার করুন, কখনই নিজের ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না। সন্দেহ হলে অবশ্যই পদক্ষেপ নিন, প্রয়োজনে পুলিশ ও অন্য সংশ্লিষ্ট এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না।
[আরও পড়ুন: উন্নত রিটার্ন পাওয়ার ঠিকানা ফ্লোটিং রেট ডেট ফান্ড, তবে বিনিয়োগের আগে মাথায় রাখুন এই বিষয়গুলি]
পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত রাখা গ্রাহকদের প্রাথমিক দায়িত্বগুলির অন্যতম। দেশের বৃহত্তম ব্যাংক, ‘স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া’র মতে, পাসওয়ার্ড প্রতি ৯০ দিন পরপরই বদল করা উচিত। এটিকে কোনও ‘পপ-আপ’-এ ব্যবহার করবেন না, কোনও কম্পিউটারে আলাদাভাবে ‘স্টোর’ করে রাখবেন না, নিজের কম্পিউটারকে মনে রাখতেও দেবেন না। ‘অটো কমপ্লিট অপশন’-এ সায় পর্যন্ত দেবেন না বলে স্টেট ব্যাংক সতর্ক করেছে। এছাড়াও, প্রতিবার অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবহার করার পর, আলাদাভাবে লগ-আউটও করে দেবেন।
সতর্কতা: যে পদক্ষেপগুলি নিলে আপনি অপেক্ষাকৃতভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারেন হ্যাকারদের আক্রমণই হোক বা অসতর্ক মুহূর্তে ভুলভ্রান্তিই হোক, আপনার ব্যক্তিগত কম্পিউটার সাবধানে ব্যবহার করতেই হবে, না হলে জালিয়াতির কবলে পড়তেই পারেন। সেজন্য এই সাবধানতাগুলি অবলম্বন করুন–
১. পাসওয়ার্ড বদল করুন খুব নিয়মিত।
২. যে ব্যক্তিকে তথ্য দিচ্ছেন তাঁকে যাচাই করুন ভালভাবে।
৩. ‘ডায়াল-আপ’ সুবিধা যদি নেন, সেটিকে মাঝে মাঝে পরীক্ষা করুন।
৪. কম্পিউটার, হার্ড ড্রাইভ, পেনড্রাইভ ইত্যাদি সাবধানে রাখুন, সবাইকে ব্যবহার করতে না দেওয়াই শ্রেয়।
৫. যখন কোনও ফাইল ডাউনলোড করবেন, সেটি যেন সুরক্ষিত/পরীক্ষিত সোর্স থেকেই হয়, দেখে নেবেন।
৬ সন্দেহজনক মেল বা অন্য বার্তা পেলে খুব সাবধানে সেটির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিন। তথ্য দেওয়া নেওয়া করবেন না সেক্ষেত্রে।
ফিশিং:
কীভাবে সুরক্ষার মাত্রা বাড়াবেন আপনার ব্যাংকের লেনদেনের ক্ষেত্রে?
এযুগের অন্যতম বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফিশিং (Phishing)- যার দ্বারা আপনার ব্যক্তিগত তথ্য এক লহমায় দুষ্কৃতীদের হাতে চলে যেতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে গায়েব হয়ে যেতে পারে আপনার সযত্নে সঞ্চিত অর্থ।
দুর্বত্তদের পন্থা মোটামুটি একই। আপনার কাছে একটি Spam (স্প্যাম) ইমেল আসবে, যা দেখে মনে হবে সেটি আপনি নিজের ব্যাংক থেকেই পেয়েছেন। এই ইমেলটি হয়তো বলবে যে সঙ্গে লিঙ্কটি ক্লিক করে খুলতে। তারপর User ID ও Password দিতে বলা হবে। এবং সেটিই হবে আপনার বিপদের শুরু। সেই জন্য ব্যাঙ্ক বা অন্য সংস্থার (হয়তো ঋণ নিয়েছেন সেই সংস্থাটির মাধ্যমে) পাঠানো প্রতিটি মেল যাচাই করেই তবে খুলবেন। বহুবার দেখা গিয়েছে অসতর্ক অবস্থায় গ্রাহক কোনও কিছু ‘ভ্যালিডেট’ করে দিচ্ছেন, হয়তো তাঁর অ্যাকাউন্ট ‘সাসপেন্ডেড’ হয়ে যাবে বলে কোনও বার্তা এসেছে বলে। নিজস্বভাবে ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে তবেই এ সমস্ত পদক্ষেপ নেবেন, নচেৎ নয়।
দেশের কয়েকটি প্রধান ব্যাংকের ওয়েবসাইট খুঁটিয়ে দেখে বুঝেছি, প্রতিটি বড় ব্যাংকই গ্রাহকদের সুবিধার্থে কিছু ‘গাইডলাইন’ তৈরি করেছে, যাতে তাঁরা অনলাইন ফ্রডের হাতে পড়ে নাস্তানাবুদ না হন। যেমন ধরুন Axis Bank-এর কথা। এঁদের গঠন করা সতর্কবার্তার অংশবিশেষ নিচের পয়েন্টগুলির মাধ্যমে তুলে ধরলাম–
(১) অযাচিতভাবে দেওয়া ফান্ড ট্রান্সফারকে বিশ্বাস করবেন না। বিশেষত, ফরেন কারেন্সি পাওয়া যাবে বলে মেসেজ পেলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে যান।
(২) পরে বড় অঙ্কের অর্থ পাবেন, তাই কমিশন বা ইনিশিয়াল ডিপোজিট দিন – এমন বার্তা পেলে একেবারেই এড়িয়ে যান। লোভ দেখাবে অপরাধীরা, ক্ষতি হবে আপনারই, মনে রাখুন।
(৩) লটারি, মানি সার্কুলেশন, প্রাইজ, কনটেস্ট ইত্যাদি কোনও সন্দেহজনক স্কিমের অংশীদার হবেন না।
(৪) ব্যাংক কখনও ব্যক্তিগত তথ্য চায় না;, তাই কেউ যদি ব্যাংকের ম্যানেজার বা অন্য কর্মী হিসাবে পরিচয় দিয়ে আপনার কাছে ব্যক্তিগত তথ্য চায়, একেবারেই দেবেন না।
(৫) যখন অনলাইন শপিং করছেন, খুব সতর্ক থাকুন। অ্যান্টি ভাইরাস ও অ্যান্টি স্পাইওয়্যার স্প্যাম ফিল্টারগুলি যেন থাকে, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখুন সর্বদা।
(৬) অন্লাইন রিটেলার বা ভেন্ডার যদি ব্যক্তিগত তথ্য চায়, আর এগোবেন না। সমস্ত শপিং ওয়েবসাইটই যে সুরক্ষিত এমন ভাবা ভুল।
সাইবার ফ্রড হেল্পলাইন: ১৫৫২৬০
আপনি যদি সাইবার ফ্রডের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে ‘১৫৫২৬০’ হেল্পলাইনের সুযোগ নিতে পারেন। ‘সঞ্চয়’ নিজস্বভাবে এর উপযোগিতা যাচাই করেনি, তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এই হেল্পলাইন নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজ্যে চালু হয়েছে। ডিজিটাল পেমেন্টের জমানায় নানা ধরনের অপরাধ হয়ে চলেছে যার জন্য একটি সুষ্ঠু ‘রিপোর্টিং প্ল্যাটফর্ম’ দরকার বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য, ফ্রডের শিকারকে যথারীতি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা অন্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতেই হবে। এ ব্যাপারে লগ্নিকারী তথা ‘সঞ্চয়’-এর পাঠককে আলাদাভাবে জেনে নিতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
(লেখক লগ্নি বিশেষজ্ঞ)