জীবন বিমা বা স্বাস্থ্য বিমা কেনার পর যদি পছন্দ না হয়, তখন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ফেরত দেওয়ার সুবিধা গ্রাহকরা পান। একে বলা হয় ‘কুলিং অফ’ বা ‘ফ্রি লুক’। কীভাবে এই পরিষেবার সুবিধা গ্রাহকরা পেতে পারেন, বিস্তারিত জানালেন বিমা পর্যবেক্ষক দেবাশীষ নাথ
প্রায় আড়াই দশক আগে, যখন বিমা ক্ষেত্র উন্মুক্তকরণের উদ্যোগ সরকারীভাবে নেওয়া হয়, তখনই বিমা কোম্পানিগুলোকে এবং তাদের কার্যপদ্ধতিগুলোকে নজরে রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা IRA (Insurance Regulatory Authority), যা পরে নাম বদলে হয় IRDAI (Insurance Regulatory and Development Authority of India)। ভারতীয় জীবন বিমা নিগম (LIC) গঠনের আগে যে সব জীবনবিমা কোম্পানিগুলো ছিল, তাদের বিরুদ্ধে লোক ঠকানোর অভিযোগ ছিল বিস্তর। বিমাক্ষেত্র উন্মুক্তকরণের পর নতুন নতুন বেসরকারি কোম্পানিগুলো যাতে মানুষকে ঠকাতে না পারে তাই একেবারে শুরু থেকেই এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে গঠন করা হয়। IRDAI, বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ধাপে ধাপে নানান নিয়ম কানুন ও বিধিনিষেধ জারি করতে থাকে। বেনিয়মের ক্ষেত্রে অনেক বিমা সংস্থাকে আর্থিক জরিমানাও দিতে হয়।
নামের মধ্যেই যেহেতু Development বা উন্নয়ন শব্দটি আছে, তাই নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি IRDAI বিমা ক্ষেত্রে উন্নতিসাধনের উদ্দেশে এই আড়াই দশকে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। এই সব নানান পদক্ষেপের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কিন্তু বিমা গ্রাহক। তাঁদের সুবিধার্থে ও তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার যাবতীয় কর্মকাণ্ড। বিমাক্ষেত্রের এই সব কর্মকাণ্ড যদিও সাধারণ গ্রাহকদের গরিষ্ঠ অংশেরই নজর এড়িয়ে যায়। যেমন জীবনবিমা বা স্বাস্থ্যবিমা কেনার পর তা পছন্দ না হলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ফেরত দেবার সুবিধা। ইংরেজিতে একে বলা হয় Cooling Off বা Free Look।
[আরও পড়ুন: কেবলমাত্র লার্জ ক্যাপে লগ্নি করতে চান? জেনে নিন সঠিক পন্থা]
বিমাক্ষেত্র বেসরকারিকরণের আগে, যখন সরকারি বিমা সংস্থাই শুধু ছিল, তখন এই ধারণাটাই ছিল না। পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনে হয় যে, যদি কখনও গ্রাহককে ভুল বুঝিয়ে বিমা প্রকল্প বিক্রি করা হয় বা গ্রাহক নিজে ভুল বুঝে কোনও প্রকল্প ক্রয় করেন এবং বিমাপত্র হাতে পাওয়ার পর ভুল বুঝতে পারেন–তাহলে তাঁকে সেই বিমা ফেরত দেওয়ার একটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ। এই ভাবনা থেকেই চালু হয় Cooling Off/Free Look-এর সুবিধা।
এই সুবিধার ফলে বিমাপত্র হাতে পাওয়ার পরে যদি বিমা গ্রাহক বুঝতে পারেন যে, যে রকম বিমা তিনি চেয়েছিলেন, ক্রয় করা বিমাটি আসলে তেমন নয়, তাহলে বিমাপত্র হাতে পাওয়ার দিন থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানির কাছে তা ফেরত দেওয়ার আবেদন জানাতে পারেন। এই নির্দিষ্ট সময়টিকেই বলা হয় Cooling Off period বা Free Look period। আবেদনের ভিত্তিতে বিমা সংস্থা বিমা চালুর দিন থেকে আবেদনের দিন পর্যন্ত সময়ের জন্য বিমারাশির ঝুঁকির আনুপাতিক প্রিমিয়াম ও বিমাপত্র তৈরির খরচ বাদ দিয়ে জমাকৃত প্রিমিয়ামের বাকি টাকা বিমা গ্রাহককে ফেরত দিতে বাধ্য থাকে।
মনে রাখা দরকার, এই সুবিধা কিন্তু পলিসি সারেন্ডার নয়। এই সুবিধা চালু হবার সময় Free Look period ছিল ১৫ দিনের। অতি সম্প্রতি বিমা নিয়ামক সংস্থা এই সময় বাড়িয়ে ৩০ দিন করেছে। এর ফলে বিমাগ্রাহক বিমাপত্র হাতে পাওয়ার দিন থেকে বিমার সুবিধাগুলি বুঝে নেবার জন্য প্রায় ১ মাস সময় পাচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে এই ব্যবস্থা গ্রাহকস্বার্থের পক্ষে বলেই মনে হয়।
কিন্তু বিমা ক্রয়- বিক্রয়ের ক্ষেত্রে গ্রাহক মনস্তত্ত্বেরও একটি বিরাট ভূমিকা আছে। নিজের জন্য বা পরিবারের কারওর জন্য জীবনবিমা বা স্বাস্থ্যবিমা কেনার পেছনে একটি ভয়ের মনস্তত্ব কাজ করে। অসুখ-বিসুখ হলে ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ চালানোর বা মৃত্যুতে পরিবারের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার ভয় থেকেই মানুষ বিমা ক্রয় করে। যেহেতু বিমার প্রকল্পগুলো বা নির্দিষ্ট একটি প্রকল্পের সুবিধাবলি বেশ জটিল বিষয় এবং তা বুঝতে গেলে হয় ক্রেতাকে সময় ব্যয় করে আর যথেষ্ট মনোনিবেশ করে তা বুঝতে হবে। অথবা কোনও বিমা এজেন্টের কাছ থেকে তা বুঝে নিতে হবে। সহজে বুঝে নেবার জন্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই গ্রাহক এজেন্টের ওপর নির্ভর করেন। সেক্ষেত্রে নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে এজেন্টের ভুল বোঝানোর সম্ভাবনা থাকলেও অভিজ্ঞতা বলে এরকম ঘটে খুব কম ক্ষেত্রেই।
[আরও পড়ুন: লগ্নি করুন বাজারের গতি বুঝে, সঠিক পথ জেনে নিন বিশেষজ্ঞের থেকে]
তাই বিমাপত্র হাতে পাওয়ার পর এজেন্টের ভুল বোঝানোর কারণে Cooling Off-এর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। বরং বর্তমান প্রতিযোগিতার যুগে কোন প্রতিযোগী এজেন্ট বা প্রতিযোগী সংস্থা বিমাগ্রাহককে ভুল বুঝিয়ে তাঁর ক্রয় করা নতুন বিমা প্রকল্পটি Cooling Off করে দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে পারে। এই সব ক্ষেত্রে Cooling Off period যত বেশি থাকবে, প্ররোচিত করার সুযোগও থাকবে তত বেশি। তাই এই Cooling Off period ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩০ দিন করে দেওয়া ঠিক না ভুল তা নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ।
এছাড়াও বিশেষ কোনও এক সময়ে বিমা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত/আগ্রহ পরবর্তী সময়ে ততখানি তীব্র নাও থাকতে পারে এবং Cooling Off-এর সুযোগ পাওয়া গেলে অকারণে সে সুযোগ নেওয়ার ইচ্ছা জাগতে পারে। এক্ষেত্রে ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাবে পরিবার এবং অসুস্থতা, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। সেক্ষেত্রেও এই সময়সীমা ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩০ দিন করে দেওয়া সঠিক কি না–তা-ও নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ।