রামের জামা শ্যামের গায়ে আঁটবেই কি? নয় তো? তাহলে লগ্নির ক্ষেত্রে আপনার যা প্রয়োজন, তা যে অন্যের সঙ্গে মিলবে না, সে বিষয়ে তো নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল! কারণ, প্রত্যেক লগ্নিকারী একে অন্যের থেকে আলাদা। আর আজকের দুনিয়ায় ‘আদর্শ’ বলে কোনও কিছুরই অস্তিত্ত্ব নেই। উদাহরণ-সহ বুঝিয়ে বললেন বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ দিলীপ কুমার দে
ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব দেশের লগ্নির বাজারকে দ্রুত বাড়াচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু যে টাকার অঙ্কে তার প্রতিফলন হচ্ছে তা নয়। বিনিয়োগের ঊর্ধ্বগামী সূচকই তার প্রমাণ। ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য শুধুমাত্র দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগকারীরা মেনস্ট্রিম বাজারমুখী হয়েছেন। বিশেষত নতুন প্রজন্মের লগ্নিকারীরা রক্ষণশীল ন্যাশনাল সেভিংস স্কিম (এনএসসি) ধরনের প্রকল্প বা ফিক্সড ডিপোজিটের উপর শুধুমাত্র নির্ভরশীল না হয়ে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে আগ্রহী। নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এসেছে নতুন স্টক বা মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নির সুযোগ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিমাক্ষেত্রের বিকল্পের সংখ্যাও। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, বিমাকে বিনিয়োগের বিকল্প হিসাবে দেখা চলবে না, বিমাকে রিস্ক কভারেজের ইনস্ট্রুমেন্ট হিসাবে দেখতে হবে। জীবন বিমা দরকার বিমাকারীর জীবনের ঝুঁকির বিনিময়ে বিমাকারীর উপর নির্ভরশীল পরিবারের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।
‘এনডাওমেন্ট’, ‘মানি-ব্যাক’ ইত্যাদি পলিসিগুলো কখনওই বিমাকারীর জীবনের ঝুঁকির প্রকৃত সুরক্ষা দিতে পারে না। আবার বিনিয়োগের জন্য এগুলোকে ইনভেস্টমেন্টও বলা যায় না। কারণ ‘মানি-ব্যাক’ বা ‘এনডাওমেন্ট’ ৩-৫% এর বেশি রিটার্ন দিতে পারে না। তাই প্রকৃত ঝুঁকির জন্য টার্ম ইনসিওরেন্স প্ল্যানই বিমাকারীর পক্ষে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। ‘এনডাওমেন্ট পলিসি’-র প্রিমিয়ামের টাকার যদি কিছুটা অংশ টার্ম প্ল্যান এবং বাকিটা অন্য যে কোনও ইনভেস্টমেন্ট যেমন ফিক্সড ডিপোজিট বা মিউচুয়াল ফান্ডে রাখা হয়, তাহলে একদিকে যেমন ‘এনডাওমেন্ট পলিসি’-র ম্যাচিওরিটি ভ্যালুর থেকে অনেক বেশি রিটার্ন পাওয়া যাবে। আবারও ‘সাম অ্যাসিওর্ড’ ও ‘এনডাওমেন্ট পলিসি’-র থেকে অনেক গুণ বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়।
সেই কারণে যে কোনও ইনসিওরেন্স কোম্পানি বা যে কোনও বিমা প্রতিষ্ঠানের অফিসারের কথায় বিশ্বাস না করে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে ইনসিওরেন্স পলিসিতে বিনিয়োগ করবেন। কিছু ক্ষেত্রে এই সব অফিসার তাঁদের নিজস্ব স্বার্থে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এজেন্ট-দেরও বিভ্রান্ত করেন এবং আপনাদের ভুল পলিসিতে লগ্নি করতে বাধ্য করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, আমি কিন্তু এই প্রসঙ্গে সমস্ত ইনসিওরেন্স সংস্থার অফিসারের কথা বলছি না।
[আরও পড়ুন: বিমার আওতা থেকে যেন বাদ না আপনার আদরের পোষ্যটিও, জেনে নিন খুঁটিনাটি]
বর্তমানে শেয়ার বাজারের উত্থান দেখে অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন যে, উঠতি বাজারে শেয়ার বা ইক্যুইটি ফান্ডে বিনিয়োগ করা যথাযথ হবে কি না! না কি মার্কেট কারেকশন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব?–এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। যে সূত্রগুলি এখানে আলোচনা করা দরকার, তার মধে্য প্রথমত রয়েছে : বিনিয়োগকারীকে নিজের ঝঁুকি নেওয়ার ক্ষমতা বুঝে নিতে হবে। এবং সেই অনুযায়ী নিজের বিনিয়োগের বিন্যাসটি সাজাতে হবে যাতে তার ভবিষ্যৎ জীবন নিশ্চিত থাকে। দ্বিতীয়ত : মার্কেট সূচকের ঊর্ধ্বগতি যেন মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি লগ্নিকে নিরুৎসাহিত না করে। মাথায় রাখতে হবে শেয়ারের দাম যেমন বাড়বে, তেমনই কমে যাওয়ার সম্ভাবনাও অস্বাভাবিক নয়। সেই ক্ষেত্রে আপনি যদি শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগের দিকে না তাকিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বা মধ্যমেয়াদি বিনিয়োগ করেন, তাহলে ভ্যালুয়েশন বাড়ানোর জন্য সময় এবং সুযোগ, দুই-ই পাবেন।
লগ্নিকারীরা যদি সময়ের অভাবে বিনিয়োগ করতে না পারেন (কারণ হয় সময় দুর্মূল্য অথবা মার্কেট সম্পর্কে সম্যক ধারণা যদি না থাকে), সেই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শদাতার সাহায্য নিতে পারেন। ইকুইটিতে বিনিয়োগ করুন। নিয়মিতভাবে ইকুইটিতে বিনিয়োগ করুন, পরামর্শ নিন বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞদের। সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্য মিউচুয়াল ফান্ডই হল সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক মাধ্যম। পাশাপাশি ‘ডিরেক্ট শেয়ার’-এর তুলনায়ও নিরাপদ মাধ্যম।
সিপ বা সিস্টেম্যাটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান নিয়ে নতুন কিছু বলার প্রয়োজন এই মুহূর্তে দেখছি না। সিপ-এর মাধ্যমে নিয়মিত বিনিয়োগের অভ্যাস গড়ে উঠবে এবং এর সুদূরপ্রসারী ফল আপনার। নিজেরাই দেখতে পাবেন। বহু মানুষ অতীতে এর ফল পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও পাবেন বলে আমি আশাবাদী। সিপ ইনভেস্টমেন্ট আপনাকে অনুশাসনের মধ্যে রাখবে। এর মাধ্যমে কস্ট অ্যাভারেজিং তথা পাওয়ার অফ কম্পাউন্ডিং পাবেন লগ্নিকারী। অটো ইনভেস্টমেন্ট অপশন বিনিয়োগকারীকে বিরাট সুবিধা দিতে পারে।
আগামীর প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে আমি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই। তবে দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতা এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আমাকে এই আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। ভারতীয় স্টক মার্কেটে অনেক ইতিবাচক ট্রেন্ড আছে। সাধারণ লগ্নিকারীর উদ্দেশে্য বলব–ভালো লাভের আশায় সংযত থাকুন, আপনার ঝঁুকি নেওয়ার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। ভালো ফান্ড নির্বাচন করুন। নিজের হোল্ডিংগুলি যথেষ্ট ডাইভারসিফায়েড কি না, তা দেখে নিন। কয়েকটি ফান্ড চিহ্নিত করুন ‘কোর’ হিসাবে তার সঙ্গে আরও কয়েকটি থাকুক ‘স্যাটেলাইট’ হিসাবে। এই দ্বৈত পন্থা–কোর এবং স্যাটেলাইটের মিশ্রণ আপনার পোর্টফোলিওগুলিকে সম্পূর্ণ আকার দেবে। আবার এরই সঙ্গে যোগ করতে পারেন দু-চারটি ‘স্ট্র্যাটেজিক’ বিনিয়োগ। একান্তভাবে সুযোগসন্ধানী বিনিয়োগকারীরা এই ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন এবং প্রয়োজন মনে করলে লগ্নি করেন। তবে তার জন্য চাই যথেষ্ট সতর্কতা এবং চটজলদি পদক্ষেপ নেওয়ার মনোভাব।
এবার প্রশ্ন করতেই পারেন, পুরনো পন্থায় কি একেবারেই বিশ্বাস রাখব না? আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই ফিক্সড ডিপোজিট বা ডেট-এর থেকে দূরে থাকার কথা আমি কখনওই বলব না। যদি দরকার হয়, তাহলে অবশ্যই এতে লগ্নি করতে পারেন। যদি কেউ ডিপোজিট লগ্নি করে সুদজনিত উপার্জনের ভিত্তিতে আয়ের প্রয়োজন হয়, তাহলে অবশ্যই ফিক্সড ডিপোজিট, আরবিআই বন্ড ইত্যাদি করতে হবে। তার সঙ্গে আপনারা মিউচুয়াল ফান্ডে ‘এসডব্লুপি’ পদ্ধতিতে লগ্নি করতে পারেন, যেখানে আপনারা রেগুলার, মান্থলি, কোয়ার্টারলি বা ইয়ারলি রিটার্ন পাবেন।
১৪০ কোটি মানুষের দেশে বহু মানুষ মানুষ সংসার চালানোর জন্য সুদজনিত আয়ের উপর নির্ভরশীল। তার মধে্য প্রবীণ মানুষও আছেন। ফিক্সড ইনকাম থেকে নির্দিষ্ট আয় তাঁদের জন্য একেবারেই সঠিক প্রেসক্রিপশন। বাজার-জনিত অনিশ্চয়তা তাঁদের জন্য আদর্শ নয়। এমন হতে পারে যে ব্যাঙ্ক থেকে তাঁর সুদের আমদানি কম হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে কর্পোরেট ডিপোজিটের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করা যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, ভরসা বা নিরাপত্তা এই সব ক্ষেত্রে খুবই জরুরি বিষয়। এক্ষেত্রে যা আমি সব সময়ই বলে থাকি।
আমাকে অনেকে বলেন তাঁদের জন্য আদর্শ পোর্টফোলিও গঠন করে দিতে। আসলে প্রতিটি লগ্নিকারী ‘স্বতন্ত্র’। ‘সব কিছু সকলের জন্য’–কথাটি প্রযোজ্য নয়। তবুও কিছুটা রক্ষণশীলভাবে বলা যায়, অনেক সময় ৫০ : ৫০ অ্যাসেট অ্যালোকেশন কার্যকরী হতে পারে। অর্থাৎ তাঁদের সম্পদের অর্ধেক চিহ্নিত করে রাখুন রেগুলার ইনকামের জন্য। বার্কি অর্ধেক সক্রিয় লগ্নি বাজারে যেখানে রিটার্ন অনিশ্চিত হলেও সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। তবে আগেই বললাম, ‘আদর্শ’ বা ‘সকলের জন্য’ বলে কিছু হয় না আজকের দিনে। কোন অ্যালোকেশন আপনার জন্য যথাযথ এবং কোনটা নয়, সেটা বুঝে নিন তাড়াতাড়ি।
বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ, পেশাদার পরামর্শদাতার (কনসালট্যান্ট) সাহায্য নিতে পারেন, তাঁদের পরামর্শে এগিয়ে চলুন। বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করুন। এই চ্যালেঞ্জ প্রতিটি ইনভেস্টর যেন ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন। প্রতিটি লগ্নিকারী/পাঠকের জন্য রইল আমার এই বার্তা। এই অর্থবর্ষ দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। হয়তো ইতিমধ্যেই আগামী ২০২৪-২০২৫ এর জন্য পরিকল্পনা করেছেন আপনারা। আশা করি, নতুন ফিনান্সিয়াল ইয়ারে সম্পদ গঠন এবং নিয়মিত উপার্জন–দুভাবেই আপনাদের সাফল্য এনে দেবে।