ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে কিন্তু বরাবরই ‘আড়ি পাতা’-র চরিত্র ছিল। কংগ্রেসও কি আড়ি পাতেনি? কিন্তু যে কেন্দ্রীয় সরকার অক্সিজেনের অভাবে কোভিড রোগীর মৃত্যু অস্বীকার করে, যারা বলে, গত বছর পরিযায়ী শ্রমিকদের কোনও সংকট ছিলই না, তারা হ্যাকিংয়ের অভিযোগে মুখ খুলবে, এটা ভাবা হচ্ছে কোন আক্কেলে? লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই।
এদেশে নরেন্দ্র মোদির আধিপত্য বিস্তারের বহু আগে ছিল নেহরু-গান্ধীদের সর্বেসর্বা সাম্রাজ্য! গোয়েন্দা বিভাগের প্রাক্তন যুগ্ম পরিচালক এম. কে. ধর তাঁর ‘ওপেন সিক্রেট্স: ইন্ডিয়া’জ ইন্টেলিজেন্স আনভেইল্ড’ বইয়ে লিখেছেন, কীভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বউমা মানেকা গান্ধীর উপর নজরদারি আরোপ করেছিলেন। এমনকী, ধর মহাশয় রাজীব গান্ধী সরকারের নজরদারির হাঁড়িটিও ভেঙেছেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংয়ের উপর নজরদারি এমনই চাগাড় দিয়েছিল যে, শেষমেশ মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে তাঁর সমস্ত ব্যক্তিগত বৈঠক বা আলাপ-আলোচনা তাঁর অফিসে না-করে রাষ্ট্রপতি ভবনের সবুজঘেরা মুঘল বাগিচায় সারতে হত। তা, মোদি সরকার নাকি ইজরায়েলি স্পাইওয়্যার নিয়ে মোবাইল ফোনে আড়ি পাতছে- নজরদারির এই অপ্রমাণিত অভিযোগ নিয়ে বিজেপি সমর্থকরা কেন এত অকারণ তক্ক জুড়ছে এবং ‘ওরা করেছে, আমরাও করছি’ ভাষ্য নামিয়ে আনছে? মুশকিল হল, এই ‘তু তু-ম্যায় ম্যায়’ বা ‘হোয়াট-অ্যাবাউট্রি’-র উদাহরণ দিয়ে যে করে হোক নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টাই কেবল স্পষ্ট হয় না বা বিষয়টিকে আলগা করে দেওয়া হয় না; সবচেয়ে বড় বিষয় হল ‘নজরদারি’ আর ‘হ্যাকিং’-এর মধ্য যে বিস্তর ফারাক- তা অনুধাবন করার পরিসরটা নষ্ট হয়।
[আরও পড়ুন: তবে কি এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী?]
সন্দেহ নেই, ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে বরাবরই ‘আড়ি পাতা’-র চরিত্র ছিল। রাজনৈতিক পরিসরে যদি গোয়েন্দা সংস্থাগুলির তেড়ে প্রয়োগ না-ই হত, তাহলে সংস্থাগুলিতে এত এত অফিসারের উপস্থিতি বা অস্তিত্বর নায্যতা কোথায়? কয়েকজনকে বাদ দিলে, এদেশের এমন কোনও প্রধানমন্ত্রী নেই, যাঁদের মস্তিষ্কে এই ধারণা জমাটবদ্ধ নয় যে- শত্রু আসলে সীমান্তের ওপারে নয়, দেশের মধ্যেই এবং নিকটস্থ প্রতিবেশী হয়েই লুকিয়ে আছে। ক্ষমতার ভয়ংকর বিড়ম্বনা, একেবারে ব্যাপক বিড়ম্বনা এটাই যে- ক্ষমতার বলয়ে থাকতে থাকতে সর্বাধিনায়কের মনে তার চারিদিকে থাকা মানুষদের নিয়েই অবিশ্বাস জন্ম নেয়। এই ঘটনা যেমনভাবে ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষমতাতন্ত্রের ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনই সত্যি মোদির ক্ষেত্রেও। কিন্তু এই দুই সময়-কালে নজরদারির চরিত্রে একটা গুণগত ও পরিমাণগত তফাত রয়েছে। এই যুগে নজরদারি আরও বহুধাবিস্তৃত, উদ্ধত এবং প্রযুক্তি-মণ্ডিত- আন্তর্জালময়। একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলানো থেকে শুরু করে নজরদারির দাপট আগের থেকে আজ অনেকানেক বেশি।
অতীতে, নজরদারিতে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। কোনও ‘টার্গেট’-কে পিছু করার জন্য নিযুক্ত ‘গোয়েন্দা’ বিষয়টি ছিল একজন ব্যক্তি- যে দৃশ্যমান। গোয়েন্দার ধরা পড়ার বা টার্গেটের আন্দাজ করে নেওয়ার সুযোগ ছিল। ল্যান্ডলাইনে যদি আড়ি পাতা হত, সেটাও কয়েকটা কথোপকথন রেকর্ড করা যেত বড় জোর, সারাক্ষণ রেকর্ড করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন, স্মার্টফোন যেখানে মন আর শরীরের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানে ‘হ্যাক’ মানে সেই ব্যক্তির জীবনের সমস্ত গলিঘুঁজি প্রকাশ্যে এসে পড়া। আর এই করাল আঁধারি মিলিটারি-গ্রেড ‘পেগাসাস’ প্রযুক্তি, যা কিনা সারাক্ষণ, প্রত্যেকটা মুহূর্ত ফোন ট্যাপিং করছে, সেখানে কোথা থেকে যে ফোনকে উদ্ধার করা শুরু করা যাবে, তার কোনও আগুপিছু নেই।
বর্তমানে যে তদন্ত চলছে এই পেগাসাস নিয়ে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৩০০ জন ভারতীয় ‘পার্সন অফ ইন্টারেস্ট’ হয়ে উঠেছে সম্ভাব্য টার্গেট। কিন্তু কে বলতে পারে, এই চক্রান্ত আরও বড় আকারে ঘটানো হয়নি? কে বলতে পারে, এখানে আরও বহু বহু লোক হ্যাকারের নজরের তলায় রয়েছে কি না। সত্যিটা হল, যদি জাতীয় সুরক্ষার অত্যাবশ্যক কারণে নজরদারি করার ব্যাপার না থাকে, তাহলে কোনও যথাযথ কারণ ছাড়া একজন নাগরিকের উপর নজরদারি চালানো মানে সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন। আর, এই নজরদারির মাত্রা যখন সব সীমা ছাড়িয়ে বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রী, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, কূটনীতিজ্ঞ, শিল্পপতি, এমনকী, বিজ্ঞানী অবধি পৌঁছে যায়, তখন বুঝতে হয়, কেবলই ব্যক্তিগত স্তরে এই উল্লঙ্ঘন আর থেমে নেই, তা সাংবিধানিক গণতন্ত্রকেও দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে।
তদুপরি, মোদি সরকারের স্পর্ধা এমন- তারা মুখের উপর এই বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেছে এবং এমনকী, সংসদে এই নিয়ে বিতর্কসভায় যেতেও অস্বীকার করেছে। তার চেয়েও বড় কথা, এই বিষয়ে তদন্তের জন্যও নির্দেশ দিতে পারেনি তারা। কেন? কারণ, একটা বর্বর সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিশ্বাস জুগিয়েছে যে, তাদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার কোনও অধিকার নেই কারও এবং সংসদের ভিতরের কোনওরকম বিবাদ বাইরে প্রতিধ্বনিত হবে না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও দেশের বৃহত্তর সমাজে তীব্র ক্ষোভের কোনও চিহ্ন যে নেই- এর থেকে বোঝা যায়, দেশের একটা বড় অংশের নাগরিক ‘হ্যাকিং’-কে জলভাত ভেবে নিয়েছে, এর ভয়াবহ ফলশ্রুতির কথা না ভেবেই! এরকম গা-এলানো ভাব এর আগে কখনও এতখানি অস্বস্তিজনক মনে হয়নি। এই আচরণের মধ্য দিয়ে প্রশাসনের কার্যকলাপকে মেনে নেওয়ার, জো-হুজুরির একটা ভয়ংকর প্রকোপ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই কার্যকলাপ যদি সত্যিই সরকারের ষড়যন্ত্র হিসাবে প্রমাণিত হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় ক্ষমতার দুর্বৃত্তিমূলক অপব্যবহার আর কিচ্ছু হতে পারে না।
এই অসাড়তা হল ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই সামগ্রিক বিবেক, যা আসলে মোদি সরকার পেগাসাসের ভূত দেখিয়ে আরও আরও দমিয়ে দিতে তৎপর। কিন্তু একটা স্তরে গিয়ে মনে হয়, এই অসাড় নিষ্ক্রিয়তার মধ্য দিয়ে দেশের অধিকাংশ নাগরিকের আচ্ছন্নতা ফুটে ওঠে, যে-আচ্ছন্নতা আসলে সাম্প্রতিক কোভিড এবং অর্থনৈতিক মন্দাজনিত ক্লান্তির ফল। সেখানে এই হ্যাকিং-বিতণ্ডা হয়তো অত্যধিক চাপগ্রস্ত মনে তেমন কাজ করছে না। কোনওভাবে, গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার সেরকম চিন্তিত করছে না অন্যান্য ব্যক্তিগত অধিকার হরণের চিন্তা যেভাবে দাঁত-নখ বসিয়েছে, সেরকম প্রেক্ষাপটে।
আবার অন্যভাবে ভেবে দেখলে, এই প্রতিক্রিয়া বর্তমানের অতি-মেরুকৃত সময়ের আয়না। যেখানে, জনমত আগের তুলনায় তীব্রভাবে বিভক্ত এবং বিভেদকামী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এমন বিপুল ভাবমূর্তি এবং তাঁর ব্যাপক জনসমর্থন, বলা ভাল সেনানীর মাঝে, তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে কিঞ্চিৎ সমালোচনা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘দেশদ্রোহিতা’। নিরন্তর ষড়যন্ত্রসুলভ এই জাতীয়তাবাদী জ্বরে আজ সমস্ত বিরোধী স্বর চাপা পড়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, টিম মোদি যে এই হ্যাকিং অভিযোগকে বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন-কৃত ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে, এতে অবাক হওয়ার আর কীই বা আছে! এই দাগিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে বক্তব্য এই: এর মধ্য দিয়ে নাকি সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে পঙ্গু করে দেওয়াটাই লক্ষ্য! এর চেয়ে বড় অসংগতিপূর্ণ যুক্তিহীনতা আর কিচ্ছু হয় না। কেন শুধু শুধু একটা ফরাসি এনজিও, ভারতের সংসদীয় কার্যকলাপ পণ্ড করার উদ্দেশ্য নিয়ে ৪৫টা দেশজুড়ে স্পাইওয়্যার হ্যাকিংয়ের ঘটনা ফাঁস করতে লেগে পড়বে, বলতে পারেন?
সত্যি হল এই- মোদি সরকার খুব ভাল করে জানে তদন্ত তাদের আরও বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেবে, যেখান থেকে উঠে আসবে রাজ্যকেন্দ্রিক নজরদারির হাল-হকিকত। যার মধ্য দিয়ে আন্দাজ করা যায়, এই সরকার কেন সংসদীয় হস্তক্ষেপের বিষয়ে একদম চুপ করে আছে, এবং একইসঙ্গে একটা মূল প্রশ্ন থেকে তারা বারবার সরে যাচ্ছে- ইজরায়েলি সংস্থার সঙ্গে ‘পেগাসাস’ বিষয়ে কি তাদের কোনও চুক্তি হয়েছিল? এই বিষয়টি কোনওভাবে স্বীকার করে নেওয়া মানেই হবে, সরকার অন্যায় ও গর্হিতভাবে ফোন হ্যাক করছে, যা ‘তথ্য প্রযুক্তি আইন’-এর বিধানকে লঙ্ঘিত করে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী তো সংসদে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ভারতে কোনওরকম সরকারি কার্যক্রমে অনধিকার নজরদারির অনুমতি-ই নেই। এই স্বীকারোক্তি ঘোরতর কপটতা। কোনও দেশই কি স্বীকার করতে পারবে যে, চোরাগোপ্তা নজরদারি কোনও গোয়েন্দা সংস্থারই অংশ নয়?
আরও বড় বিষয় হল, যে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক আওতায় তদন্তকর্মের প্যাঁচ মোদি সরকারের কাছে অভিশাপ। কারণ, এই সরকারে, যেভাবে ‘বিগ বস’ মেজাজে কাজ চলে, তা দেশের রাজনৈতিক নিয়মনীতিকে দিনের আলোয় অগ্রাহ্য করে ঘটে। এই সরকার কোভিড রোগীর অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুকে অস্বীকার করে। দাবি করে, গত বছর পরিযায়ী শ্রমিকের কোনও সংকট ছিলই না। অর্থনীতিকে সচল রাখতে পারে না, চাকরি সুনিশ্চিত করতে পারে না, চিন সীমান্তে অনধিকার প্রবেশ নিয়ে কোনও প্রমাণ দিতে পারে না। তাহলে, এরা যে এই হ্যাকিং অভিযোগ নিয়েও মুখ খুলবে- এটাই বা ভাবা হবে কোন আক্কেলে, কেনই বা তারা আইনের হস্তক্ষেপ মেনে নেবে? পেগাসাস ছিল একটা পৌরাণিক ডানাওয়ালা ঘোড়া, মিথ। সম্ভবত, এই সরকার ও তার তাঁবেদারদের মধ্যেও নজরদারি, আড়িপাতা, হ্যাকিং সবই মিথ!
পুনশ্চ ২০২১-এর দিল্লিরও আগে, ২০০৮-’০৯-এ গান্ধীনগরের কথা। আমার বই ‘২০১৯: হাউ মোদি ওন ইন্ডিয়া’-য় আমি স্পষ্টভাবে খোলসা করেছি- গুজরাটের শীর্ষস্থানীয় আইপিএস আধিকারিকদের একদিন রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডাকলেন। উদ্দেশ্য: হ্যাকিংয়ের একটি টপ সিক্রেট ডেমো প্রদর্শন। ইজরায়েল-কৃত একখান সফটওয়্যার, যা দিয়ে মোবাইলের কথোপকথনে আড়ি পাতা যাবে। জানি না, সে সময়ের স্পাইওয়্যারের রূপান্তরই ‘পেগাসাস’ কি না, তা শেষমেশ কার্যকর হয়েছিল, না হয়নি! কিন্তু যেটা আমরা জানি, তা হল, সে সময় গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন অমিত শাহ। আর, এখন তিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী!