সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: বাথরুমে জল ঢাললেই দরজার আশেপাশে দেখা যাচ্ছে একটা হাত। কখনও এক জায়গায়। আবার কখনও নড়াচড়া করছে। সেই সঙ্গে রাত হলেই বাথরুমের পাশ থেকে ভেসে আসছে শিশুর কান্না। বিড়ালের ডাক। বছরখানেক ধরে পুরুলিয়ার খনি অঞ্চল নিতুড়িয়ার গার্লস হাই স্কুলের কস্তুরবা হোস্টেলে এমন সব অলৌকিক কাণ্ড কারখানায় ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছে আবাসিকরা।
তারা বারেবারে হস্টেল কর্তৃপক্ষ-সহ স্কুলের শিক্ষিকাদেরকে বললেও ওই পড়ুয়াদের অভয় দেওয়া যায়নি। বরং ভূতের আতঙ্ক দিন দিন ক্রমশ চেপে বসছে। যার দরুন ৮৩ জন আবাসিকের মধ্যে হস্টেল ছাড়তে ছাড়তে আবাসিকের সংখ্যা বর্তমানে ঠেকেছে ৫৩ জনে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে স্কুলের পরিচালন সমিতি পুরুলিয়া জেলা বিজ্ঞান মঞ্চের দ্বারস্থ হয়। মঙ্গলবার পুরুলিয়া জেলা বিজ্ঞান মঞ্চের সম্পাদক-সহ প্রতিনিধিরা সেখানে গিয়ে সচেতনতার প্রচার করেন। ভূত বলে কিছু নেই বলেও তাঁরা অভয় দেন। ওই হাতের গল্প শুনে নানান মজা-মশকরা করেন। হাত দেখলে আবাসিকদেরকে টেনে ধরতে বলেন। ঝাঁটা নিয়ে মারতে বলেন। যাতে আতঙ্ক কাটে। কিন্তু বিজ্ঞান মঞ্চ যাওয়ার একদিন পরেও সেই ভয় কাটেনি। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কবিতা চক্রবর্তী জানান, “আমি বুধবার স্কুলে যায়নি। বৃহস্পতিবার গিয়ে বুঝতে পারব ওই হস্টেলের কী অবস্থা। আমরা ধারাবাহিকভাবে ছাত্রীদের বোঝাচ্ছি ভূত বলে কিছু নেই।”
[আরও পড়ুন: ‘যত্ত সড়কছাপ…’! ‘ডাঙ্কি’ মুক্তির আগে ফের শাহরুখকে খোঁচা সমীর ওয়াংখেড়ের?]
কিন্তু বোঝালে হবে কী? সন্ধ্যে নামলেই আবাসিকদের চোখের সামনে ভাসছে ওই হাত! আর সেই কারণেই গত এক বছরে ৩০ জন আবাসিক ছাত্রী ওই হস্টেল ছেড়ে দিয়েছে। এমন ভূতের ভয় কাটাতেই পুরুলিয়া জেলা বিজ্ঞান মঞ্চ সেখানে রাত কাটানোর কথাও জানায়।
পুরুলিয়ার কোটশিলার বেগুনকোদর স্টেশনে যে কোনো ভূত নেই সেটা বোঝাতেও কয়েক বছর আগে রাত জেগেছিল পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলার প্রতিনিধিরা। রাত জেগে প্রমাণ করেছিল আর যাই থাক বেগুনকোদর স্টেশনে কোন ভূত নেই। এই ভূতের গুজব ধরে রাখতে এক অসাধু চক্র কাজ করছে বলেও বিজ্ঞান মঞ্চ পুলিশকে জানায়। কিন্তু তারপরেও ভূত চতুর্দশী এলেই বেগুনকোদরকে নিয়ে হইচই বেঁধে যায়। আজও ভূতুড়ে স্টেশন তকমায় বেগুনকোদর সামাজিক মাধ্যমে ঘোরাফেরা করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের যেকটি ভুতুড়ে স্টেশন রয়েছে তার মধ্যে নাকি অন্যতম বেগুনকোদর! সেই বেগুনকোদরের কথা তুলে ধরেও বিজ্ঞান মঞ্চ ছাত্রীদেরকে বোঝায় ভূত বলে কিছু হয় না।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের সম্পাদক তথা চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, “হস্টেলের আবাসিকদের সঙ্গে আমরা বিশদে কথা বলেছি। কোথা থেকে এই ভূতের গুজব ছড়িয়ে পড়ছে তা খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করছি। কোনও এক রাতে এক ছাত্রী হোস্টেলের বাথরুমের কাছে একটা হাত দেখতে পাওয়া থেকেই আতঙ্ক ছড়ায়। তবে কিশোরী মনে এমন ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। মেয়েটি কোনও ভূতের গল্প পড়েছিল বা মোবাইলে ভূত সংক্রান্ত কিছু দেখে থাকতে পারে। তারই ছাপ পড়েছিল মনে। আর সেই থেকেই হ্যালুসিনেসনের শিকার হয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ” তবে ওই দিন বিজ্ঞান মঞ্চ বাথরুমের কাছে গিয়ে দেখতে পায় দেওয়ালে সত্যি সত্যি-ই একজোড়া হাতের ছাপের চিহ্ন। যা দেখে আঁতকে ওঠেন শিক্ষিকারাও। তারা বলতে থাকেন, “ওই হাতের কথা তো আগে শুনিনি। এতদিন বিড়ালের আওয়াজ, শিশুর কান্নার কথা শুনছিলাম।” কোন আবাসিক ছাত্রী এই প্রথম হাত দেখেছিল এদিন তা জানার চেষ্টা করে বিজ্ঞান মঞ্চ। এমনকি সেই ছাত্রীর সঙ্গে কথাও বলে। ওই ছাত্রী জানায়, “আমি নিজে একদিনই বাথরুমের কাছে হাত দেখেছিলাম। জল ঢালার পরেই ওই হাতটা প্রথমে স্থির হয়েছিল। তারপর নড়তে শুরু করে।” ছাত্রীর এমন কথা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, দেওয়ালে থাকা হাতের ছাপের চিহ্ন চুন দিয়ে মুছে দেওয়া হবে। এদিকে এইসব কথা শোনার পর বিজ্ঞান মঞ্চ নানা পদ্ধতিতে হাতে-কলমে ওই আবাসিকদের বোঝানোর চেষ্টা করে বিজ্ঞানে ভূত, অলৌকিক বলে কোন কিছু বিষয় নেই।
[আরও পড়ুন: বুর্জ খলিফায় বাদশারাজ, ‘ডাঙ্কি’ ঝড়ে কাঁপছে বলিউডও, ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখছেন কোন তারকারা?]
স্কুল ক্যাম্পাসের মধ্যেই একটু দূরে ওই হোস্টেল। ২০০৯ সালে ওই হোস্টেলটি চালু হয়। তবে কখনও এরকম সমস্যা হয়নি। গত এক বছর ধরেই এমন ভূতের আতঙ্ক ছড়িয়ে রয়েছে ওই হোস্টেলে। ওই হোস্টেলের ওয়ার্ডেন সারথি তন্তুবায় জানান, “২০১১ সাল থেকে আমি এখানে রয়েছি। এই প্রথম এমন আজগুবি সব কথা কিছুদিন ধরে শুনছি। কতবার আবাসিকদের বুঝিয়েছি ভূত বলে কিছু নেই।” কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই ওই হাত আতঙ্ক যে তাড়া করে বেড়াচ্ছে হোস্টেল জুড়ে।