সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। আচমকা বেজে ওঠে রণদুন্দুভি। বাঁধ ভাঙা জলের মতো ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে রুশ ফৌজ। ইউরোপ থেকে আমেরিকা উঠে গেল গেল রব। মত্ত মাতঙ্গ সম পুতিন বাহিনীর সামনে খড়কুটোর মতোই ইউক্রেনীয় সেনার ভেসে যাওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু সমস্ত সমীকরণ মিথ্যা প্রমাণ করে এক অদ্ভূত-অলীক গল্প গাথা তৈরি হয়। ৯৬৭ দিন পেরিয়ে গেলেও চলছে যুদ্ধ। 'গোলিয়াথ' রাশিয়া কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না ন্যাটোর মদতপুষ্ট ইউক্রেনকে। এর এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে ভারতের ভূমিকা। সংকট কাটাতে দিল্লি দরবরাই যে ভরসা মস্কোর তা ফের প্রমাণিত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথায়। ব্রিকস সামিটের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূয়সী করলেন তিনি।
এবছর ১৬তম ব্রিকস সামিটের আয়োজক দেশ রাশিয়া। ২২ ও ২৩ অক্টোবর কাজানে হবে এই সম্মেলন। আগামী সপ্তাহে সেখানেই যোগ দেবেন মোদি। ফলে একবার তিনি মুখোমুখী হবেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে। ভারত, চিন, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়াকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্রিকস গোষ্ঠী। প্রত্যেক বছর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোনও না কোনও সদস্য দেশ ব্রিকস সম্মেলনের আয়োজন করে। গত বছরের আগস্ট মাসে এই সামিটের আসর বসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে। ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে এই সামিটের গুরুত্ব অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মত বিশ্লেষকদের। এই প্রেক্ষাপটে শুক্রবার পুতিন বলেন, "আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রতি কৃতজ্ঞ। যখনই তাঁর সঙ্গে কথা হয় তিনি ইউক্রেন সংকট সামাধানের কথা বলেন। আমরা শান্তিপুর্ণ ভাবে আলোচনার মাধ্যমে এই সংঘাতের অবসান চাই। মোদিও একই পন্থায় বিশ্বাসী। তাঁর আন্তরিক চেষ্টার জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাই।"
উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই দুদেশকে বৈঠক ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বার্তা দিচ্ছে ভারত। একাধিকবার দুই রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। গত আগস্ট মাসে মাসে ইউক্রেনে সফরে যান নমো। অধুনা বিলুপ্ত সোভিয়েতের এককালের সদস্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেন। ভারত যেভাবে ইউক্রেনের জন্য মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন জেলেনস্কি। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যেন দ্রুত যুদ্ধ মেটানো যায়, সেই নিয়ে কথা হয় তাঁদের মধ্যে। তাৎপর্যপুর্ণ ভাবে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেই গত জুলাই মাসে রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন মোদি। ফলে পর্দার আড়ালে দৌত্যের কাজও চলছে বলেই ধারণা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের। ঘটনাচক্রে দিল্লির কৌশলের উপর আমেরিকা, ন্যাটো সামরিক জোট ও চিনেরও নজর রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইউক্রেন সংকট কাটাতে দিল্লিতে কেন আস্থা মস্কোর? উত্তর খুব একটা কঠিন নয়। ইউক্রেনে মেঘনাদ যে আমেরিকা ও ন্যাটো জোট তা কারও অজানা নয়। মূলত, মার্কিনি অস্ত্র ও নগদে বলীয়ান হয়েই রুশ ফৌজকে এখনও রুখতে সক্ষম হয়েছে কিয়েভ। তবে সেই সমর্থন অনন্ত কাল চলতে পারে না। ইতিমধ্যে আমেরিকা, জার্মানি ও ব্রিটেনে এনিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দার মার ও দীর্ঘদিন অভ্যন্তরীণ জনমত অগ্রাহ্য করাও সম্ভব নয়। তাছাড়া, সামনের মাসেই আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ফলে ইউক্রেন সংকটের সমাধান খুঁজতে আগ্রহী ওয়াশিংটন। এই প্রেক্ষাপটে, ভারতের সঙ্গে পশ্চিমি দুনিয়ার সদ্ভাবকে মূলধন করে এগোতে চাইছে রাশিয়া। লোকচক্ষুর আড়ালে দুই মেরুর মধ্যে দিল্লি যে দৌত্য করছে তা স্পষ্ট। একই সঙ্গে ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে মোদির সখ্য কতটা সেকথা ভালোই জানেন পুতিন। অন্যদিকে, বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়াতে একঘরে করে দেওয়ার মার্কিন ও পশ্চিমি দুনিয়ার প্রয়াস বানচাল করায় ভারতের ভূমিকা বিশাল। ওয়াশিংটন থেকে ব্রাসেলসের ভ্রূকুটিকে আগ্রাহ্য করে রুশ অশোধিত তেল বিপুল পরিমাণে কিনছে দিল্লি। ফলে, পশ্চিমের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্বেও পুতিনের ভাণ্ডারে টান পড়েনি। তাই বন্ধু মোদির উপর পুতিনের আস্থা থাকাটাই স্বাভাবিক।