অভিষেক চৌধুরী, কালনা: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে ভেসে আসা কাঠ দিয়ে কৃষ্ণেরই মূর্তি তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। মূর্তি তৈরি করছিলেন ছদ্মবেশধারী বিশ্বকর্মা। শর্ত ছিল, বিগ্রহ তৈরির আগে কেউ তা দর্শন করতে পারবেন না। কৌতূহল দমন করতে না পেরে দরজা খুলে ফেলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। শর্ত ভাঙায়, বিগ্রহ অসম্পূর্ণ রেখে উধাও হয়ে যান বিশ্বকর্মা। সেই থেকে অসম্পূর্ণ মূর্তিই পূজিত হয় দেশজুড়ে। রথযাত্রাও হয় সেই মূর্তি নিয়েই। তবে ব্যতিক্রম কালনা।
কালনার জগন্নাথতলায় সারা বছর অসম্পূর্ণ বিগ্রহ পূজিত হলেও বছরে তিনদিন তার ব্যতিক্রম হয়। রথযাত্রা, স্নানযাত্রা ও উলটো রথযাত্রা। তিনটে দিন এই দেব-দেবীর মূর্তিতে হাত লাগিয়ে পূজার্চনা করা হয়। রথযাত্রার দিন এমনই এক ব্যতিক্রমী ছবি ধরা পড়ল কালনা শহরের জগন্নাথতলায়। গতবারের মতো এবারের রথ উৎসবেও ছিল না নজরকাড়া কোনও আয়োজন। করোনা আবহে সরকারিবিধি মেনে রথের রশিতে টান পড়ে। রীতিনীতি মেনেই নিয়মরক্ষার পুজো হয় বলে জানান উদ্যোক্তারা।
[আরও পড়ুন: গ্যাস সিলিন্ডার লিক করে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল বাড়ি, গুরুতর জখম ২]
বর্ধমানের রাজ পরিবার কালনার ভাগীরথী নদীর তীরে জগন্নাথদেবের মন্দির তৈরি করেছিল। বিশাল এলাকাজুড়ে থাকা সেই এলাকায় জগন্নাথদেবের মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত। বর্তমানে সেখানে একটি বেদী রয়েছে। তাই পাশের একটি মন্দিরে স্থানান্তরিত করে তাঁর পূজার্চনা করা হয়। এ বিষয়ে কালনার ইতিহাস ও পুরাতত্ব পরিষদের সভাপতি সিদ্ধেশ্বর আচার্য জানান, ১৭৩০ খ্রীষ্টাব্দে রাজমাতা ব্রজকিশোরীদেবী দ্বিতীয়বারের জন্য শ্রীধাম জগন্নাথধামে রথযাত্রায় গিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে কালনায় জগন্নাথদেবের মন্দির তৈরি করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। সেই মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হয় ১৭৩৩ খ্রীষ্টাব্দে। সেই থেকেই এখানে রথযাত্রা, উলটোরথ ও স্নানযাত্রা উৎসবের সূচনা হয়।
সারাবছর হাতছাড়াই পুজো হলেও এই তিন উৎসবে মূর্তিতে দু’টি করে পিতলের হাত লাগানো হয়। আর সেই থেকেই এই নিয়মের ব্যতিক্রম আজও হয়নি। এর কারণ কী? সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। তবে হাত লাগানো এমন মূর্তি কালনা ছাড়া আর কোথাও সেভাবে দেখা যায়নি বলেই জানান সিদ্ধেশ্বরবাবু।
[আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় কড়া জেলা প্রশাসন, এবার দিঘা সফরেও লাগবে কোভিড রিপোর্ট]
তিনি বলেন, “পুরী-সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। কোথাও জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা মূর্তিতে হাত দেখিনি। কালনাতেই শুধুমাত্র এই তিন উৎসবে হাত লাগিয়ে পুজো করা হয়।” এখানে একসময় বিশাল রথও ছিল বলে তিনি জানান। সেই রথ জগন্নাথ বাড়ির সামনে থেকে কোর্ট সংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত যেত। সিদ্ধেশ্বরবাবু বলেন, “জেমস লংয়ের একটি ডায়েরি থেকে জানা যায়, এখানে বিশাল আকারের রথ ছিল। এতটাই বড় রথ ছিল যে ডাকাতরাও নাকি লুকিয়ে থাকত।” যদিও সেই রথ বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। বর্ধমান রাজ পরিবারের ষ্টেটের ম্যানেজার জয়চাঁদ চট্টোপাধ্যায় জানান, “১৯৮১ সালে জগন্নাথতলায় আরও একটি রথ তৈরি করা হয়। এখনও বর্ধমান রাজ পরিবার থেকে পুজোর উপাচার ও অনুদান আসে। আটদিন আগেই দেবদেবীর অঙ্গরাগ করা হয়েছে।” তিনি আরও বলেন,“গতবারের মত এবারেও করোনাবিধি মেনেই নিয়ম রক্ষার পুজো করা হয়।”