চারুবাক: রবীন্দ্রনাথের কলমে মা-ছেলের প্রশ্নোত্তরের একটি জায়গা ছিল। ‘খোকা মাকে শুধোয় ডেকে- আমি এলেম কোথা থেকে? উত্তরে মা বলে ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।’ তারপর দীর্ঘ সংলাপে সন্তানের প্রতি মায়ের অনুরাগ জড়ানো কত কথা। স্নেহ-ভালবাসায় আর শরীরে ও মনে জড়িয়ে রাখা সন্তানকে নিয়ে সে এক দীর্ঘ সংলাপ বিলাপও বলা যায়। পরিচালক অর্জুন চক্রবর্তী ‘অব্যক্ত’ ছবির শেষপর্বে পৌঁছে মা ও ছেলের দীর্ঘকালীন ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো স্পষ্ট করতে ফিল্মিক অনুঘটক হিসেবে দারুণ বুদ্ধি এবং অসামান্য শৈল্পিক নৈপুণ্যের সঙ্গে কবিতাটি ব্যবহার করলেন। এমন সুপ্রযুক্ত মুহূর্ত সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমায় খুব কম নজরে পড়েছে। এমনকী ‘কাঁদালে তুমি মোরে ভালবাসারই ঘায়ে’ গানটির ব্যবহার শুধু পরিবেশ মাফিক নয়, ওই গানের সুরকেও সাথী (অর্পিতা) চরিত্রের একাকিত্ব ও যন্ত্রণা প্রকাশের মোটিভ করে ব্যবহার অনবদ্য।
আসলে পুরো ‘অব্যক্ত’ ছবিটাই না বলতে পারা এবং না বলা অনেক যন্ত্রণার এক মানবিক দলিল। মা, ছেলে, বাবা, বাবার বন্ধু- এই চারজনের না বলতে পারা সম্পর্কের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর জটিলতাই অর্জুনের চিত্রনাট্যের ফোকাল পয়েন্ট। তিনি সেটি সাজিয়েছেনও সাহিত্যিকের সুচারু কলম নয়, ক্যামেরা দিয়ে। সুপ্রতীম ভোলের ক্যামেরা বেশিরভাগ সময় চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থেকেও চরিত্রগুলোর মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। তাঁর ক্যামেরার সামনে আঁধার ও আলোর ব্যবহার, সচল ক্যামেরা দৃষ্টিকোণ বেশ সপ্রাণ ও অর্থবহ। সাহিত্যরসে সম্বৃদ্ধ ‘অব্যক্ত’ চিত্রনাট্য সিনেমার ভাষায়ও যথেষ্ট ধনী।
[ আরও পড়ুন: অভিনয় আর পরিচালনার দুর্বলতাই ডোবাল ‘গুল মকাই’কে ]
মা সাথীর সঙ্গে সন্তান বাবুর (অনুভব) সম্পর্ক সেই ছোট্টবেলা থেকেই ক্রিটিকাল। ছেলের ‘মেয়েলিপনা’ একেবারেই না পসন্দ মায়ের। বাবা কৌশিকের (অনির্বাণ) প্রতি বেশি অনুরক্ত ছেলে। বাবার বন্ধু রুদ্রকাকুরও (আদিল) একটু বেশি ন্যাওটা সে। মায়ের জেদেই সাহিত্য পড়া হয়নি বাবুর। পরিণত বয়সে সে ইঞ্জিনিয়র, বাড়ি ছাড়া, দিল্লিবাসী। প্রেমিকা অদিতির (খেয়া) সঙ্গে লিভ-ইন করে। বাবার মৃত্যুর পর সম্পর্কের ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে মায়ের ডাকে বাবুকে আসতে হয় কলকাতায়। মায়ের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক তখনও। স্বল্পকালীন এই উপস্থিতির মধ্যেও সাধারণ কিছু ঘটনায় সম্পর্কের জটিলতাগুলো ধীরে ধীরে আলগা হতে থাকে। দেখা হয় পুরনো ‘বন্ধু’ রুদ্রকাকুর (আদিল) সঙ্গেও। যিনি বাবার মৃত্যুর আগে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সহানুভূতির স্পর্শ নিয়ে। সম্পর্কের বরফ গলে সবার মধ্যেই। শুধু অধরা থেকে যায় মৃত বাবা। সন্তানের প্রতি মায়ের গভীর স্নেহ ও অধিকারবোধই বাবা ও রুদ্রকাকুর কাছ থেকে বাবুকে সরিয়ে রাখতে বাধ্য করেছিল। স্বামী ও স্বামীর বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কের যে শারীরিক ইঙ্গিত পেয়েছিলেন সাথী, সেখান থেকেই তাঁর ভীতির উৎস। সম্পর্কের এই জটিলতা হয়তো বা খোলসা করতে চেয়েছিলেন কৌশিক এবং রুদ্র দু’জনেই। কিন্তু পারেননি সাথীর দাপটে।
এমন একটি আধুনিক জটিল সম্পর্ক ও সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে এমন শীলিত মানবিক অনুভূতিময় ছবি সম্প্রতি দেখিনি। ত্রুটিহীন ছবি অবশ্যই নয়। কিন্তু পরিবেশনার সামগ্রিক নিপুণ ভাবনা ও সাবলীল গতিময়তা দর্শককে মাথা খাটাতে বাধ্য করে এবং বসিয়েও রাখে। তবে সাহিত্যগুণ সম্বৃদ্ধ এই ধরনের ছবি দর্শক সর্বত্রই সীমিত। এই শহরেও। থ্রিলারের চমক, চটকদারি, সংলাপের হাততালি, গোয়েন্দাগিরির বাজারি রহস্যময়তাহীন ‘অব্যক্ত’ তাই সংখ্যাগুরু দর্শকের ‘ফুটফল’ থেকে বঞ্চিত হলেও সিরিয়াস দর্শকের চোখ ও মনের খোরাক হবেই। আবার কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন গল্পের সমসাময়িকতার প্রসঙ্গ নিয়েও। কিন্তু সাহিত্যরসও সিনেমাধর্মের সুন্দর মেলবন্ধন অর্জুন ঘটিয়েছেন এই ছবিতে।
[ আরও পড়ুন: প্রতি পরতে নতুন রহস্যন্মোচন, ভিন্ন দৃষ্টিতে সমকাল দর্শন ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এ ]
অভিনয়ও এই ছবির বড় আকর্ষণ। বিশেষ করে মা সাথীর চরিত্রে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় বয়স ডিঙিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ছোঁয়া মহিলা সেজে তিনি ফিজিক্যাল অভিনয়ে এক নজির রাখলেন। পাশাপাশি ফ্ল্যাশব্যাকে তরুণী সাথী হিসেবেও চমকে দেন। গানের লিপ মেলানোতেও অভিনয় অনবদ্য। তাঁকে কেন যে আরও বেশি করে টালিগঞ্জ ব্যবহার করে না! ছেলে বাবুর চরিত্রে অনুভব কাঞ্জিলালও বেশ ভাল। মায়ের প্রতি তাঁর ক্ষোভ, রাগ অভিমান যেমন স্পষ্ট, আবার ভুল বোঝাবুঝির অবসানে আত্মসমর্পণটুকুও মনকে আর্দ্র করে। আদিল হুসেনের রুদ্র অত্যন্ত সংযত, ভদ্রজনচিত, সংবেদনশীল এবং কিছুটা অসহায়ও। একটু থিয়েটারি ঢঙে হলেও তিনি যথেষ্ট ব্যক্তিত্বপূর্ণ এবং প্রাণবন্ত। অন্যান্য চরিত্রে লিলি চক্রবর্তী, দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ঘোষ এবং বাড়ির কাজের লোকের চরিত্রে পিংকি বন্দ্যোপাধ্যায় নজরে আটকে থাকেন।
The post সম্পর্কের জটিলতা ও মানবিক অনুভূতির ছবি ‘অব্যক্ত’ appeared first on Sangbad Pratidin.