shono
Advertisement

বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মত, বলিদান বন্ধের নির্দেশ, যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে অগ্রণী মা সারদা

ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিলনবিন্দু, রামকৃষ্ণের 'শক্তি', তিনি স্বামীজির 'সংঘজননী'।
Posted: 11:58 AM Jun 03, 2022Updated: 12:01 PM Jun 03, 2022

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: তিনি কি পুরাতন আদর্শের শেষ প্রতিনিধি? নাকি নতুন আদর্শের অগ্রদূত? শ্রীশ্রীমা সারদা সম্পর্কে বলতে গিয়ে গভীর বিস্ময়ে এই মিলনবিন্দুতে এসেই পৌঁছেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। আদতে এ সংশয়, এ প্রশ্নচিহ্ন অর্থহীন। নিবেদিতা তাঁর অতুলনীয় পর্যবেক্ষণে যে সিদ্ধান্তে উপনীত, তা-ই তিনি তুলে রেখেছেন উত্তরকালের জন্য, প্রশ্নের ছদ্মবেশে। আমরা খেয়াল করলে দেখব, কী নিখুঁত তিনি বুঝেছিলেন মায়ের মহিমা। যিনি সীতা, রাধার প্রতিমূর্তি, যিনি শক্তিস্বরূপা স্বয়ং সরস্বতী, তিনি এক হাতে ধরে আছেন সভ্যতার প্রাচীন মহিমাময় আদর্শ। আর অপর হাতে বরাভয় দান করছেন সমসময়ের আধুনিকতাকে। দুই হাত এসে মিলছে সাধনার ভঙ্গিতে, আর ক্রমশ উপলব্ধি হচ্ছে জগতের যে, রামকৃষ্ণের সংসারে কী প্রগাঢ় এক বিস্ময় মা সারদা। আজ, বাগবাজারে তাঁর পদার্পণ তিথিতে স্মরণ করা যাক সেই মহিমার কথা।  

Advertisement

স্বামীজি গুরুভাইদের প্রায়শই বলতেন – ‘মা ঠাকরুণ কী বস্তু বুঝতে পারনি, এখন কেহই পারে না, ক্রমে পারবে।’ সত্যিই তো, তাঁর মহিমা কি সহজে বোঝা যায়! স্বয়ং ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে বলতেন,

অনন্ত রাধার মায়া কহনে না যায়।
কোটি কৃষ্ণ কোটি রাম হয় যায় রয়।।

অর্থাৎ তিনিই রাধা। তিনিই সীতা। তিনি ঠাকুরের থেকেও উচ্চাসনে আসীন। সে স্থান দিচ্ছেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ। ঠাকুর তো বলতেন যে, মা তাঁর শক্তি। এই শক্তিকে যদি শুধু ‘পাওয়ার হাউস’ ভাবা যায়, তবে খানিক সীমাবদ্ধ হবে সে-ভাবনা। ঠাকুরের সংসারটিকে, বলা ভালো ঠাকুরের সম্প্রসারিত সংসার-ভাবনাটিকে আজীবন লালন করে চলেছেন মা সারদা। সেই হিসেবে রামকৃষ্ণ সংঘের শক্তি যে মা, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু ঠাকুর শক্তি শব্দটি ব্যবহার করেছেন অন্য ইঙ্গিতে। এই শক্তি হল সেই শক্তি যার প্রকাশ বৈদিক দেবীসূক্তে। যে শক্তির আরাধনা ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। যে শক্তি না হলে ব্রহ্ম অসম্পূর্ণ। ঠাকুর ইঙ্গিত করছেন, তিনি যদি ব্রহ্ম হন, তবে মা-ই তাঁর শক্তি। দুজনে না মিললে তাঁদের কর্মকাণ্ড রূপ পায় না। মাকে বাদ দিয়ে তাই ঠাকুরের লীলামাধুর্য বোঝা অসম্ভব।

[আরও পড়ুন: সারদা দেবীর জন্মতিথিতে বিশেষ পুজো, বেলুড় ও বাগবাজারে মায়ের বাড়িতে ভক্ত সমাগম]

যুগাবতার রামকৃষ্ণ এসেছিলেন যুগের প্রয়োজনে ধর্মচিন্তাকে নয়া দিশা দেখাতে। শাস্ত্র মন্থন করে যে ধর্মজ্ঞান মেলে, সাধনায় যে সিদ্ধি মেলে তা ঠাকুরের করায়ত্ত। কিন্তু ধর্মবোধকে তিনি সেখানেই আটকে রাখছেন না। সময়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তাকে নতুন রূপ দিচ্ছেন। ঠাকুর তাঁর ভক্তদের যে ধর্মভাবে প্রাণিত করতে চাইছিলেন, তা গণমুখী। লোকহিতের ভিতর লুকিয়ে আছে সেই ধর্মের সার। নর রূপে নারায়ণের সেবাকে তিনি মূল করে তুলছেন। ঈশ্বরকে তিনি দূরের বস্তু করে রাখছেন না। একবার কৃষ্ণমূর্তির পা ভেঙে গেল মন্দিরে। শাস্ত্রকাররা বিধান দিলেন, ভাঙা বিগ্রহ বদলে নতুন মূর্তি গড়িয়ে নিতে। আর ঠাকুর মথুরবাবুকে বললেন, রানির জামাইয়ের যদি পা ভাঙত, তবে কি তা বিসর্জন দিতেন রানি? নাকি ভাঙা পা সারিয়ে নিতেন! এই সাধারণ একটি ঘটনাই বলে দেয়, ঠাকুরের সাধনার অভিমুখ যুগের নিরিখে কতখানি অন্যরকম। যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষ শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করেছে। ঠাকুর চান, সেই জ্ঞান এবার মানুষের হিতে কাজে লাগুক সরাসরি। ঠাকুরের ধর্মকথার এই সারটুকুকে বর্ণনা করতে স্বামীজী তাই একটি শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন – ‘লোকহিতচিকীর্ষা’। মা সারদাকে না চিনলে এই শব্দের বাস্তব রূপ প্রকৃত অর্থে অধরাই থেকে যায়।

ঠাকুর যেমন ধর্মভাবনাকে প্রসারিত করছেন, মা-ও তেমন ঠাকুরের পাশটিতে থেকে ভারতবর্ষের আবহমানের শক্তির রূপকে সম্প্রসারিত করছেন। তাঁর ভিতরই প্রজ্জ্বলিত আছে চিরায়মানা সেই শক্তি। তিনি সীতা, রাধা। আবার তিনিই বীরাঙ্গনা। কিন্তু কেমন হবে নতুন যুগের বীরাঙ্গনা? ভগিনী নিবেদিতা বাগবাজারে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছেন। মেয়েরা শিক্ষা পাক, এই তাঁর ইচ্ছে। সেই কাজে সানন্দে সম্মতি দিলেন স্বয়ং শ্রীমা। নিজে দাঁড়িয়ে উদ্বোধন করলেন বিদ্যালয়ের। গৌরীমা-র বালিকা বিদ্যালয়ের জন্যও তাঁর অনন্ত কৃপা। মেয়েরা পড়াশোনা করছে জেনে তিনি ভারী আনন্দিত। কোনও অল্পবয়সি মেয়ের কেবল নিয়মের খাতিরে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে জানলে, তিনি ভারী আক্ষেপ করতেন। শ্রীমা মনেপ্রাণে চাইতেন, রক্ষণশীলতার বেড়া ভেঙে একটা নতুন সমাজের জন্ম হোক।

একবার নবমীতে স্বামীজির ইচ্ছা, দেবীর সামনে বলিদান হোক। মাকে সে-কথা জানাতেই তিনি নাকচ করে দিলেন। যাঁরা সন্ন্যাসী, তাঁরা তো সর্বভূতে অভয়প্রদান করবে। তাঁরা প্রাণী নিধন করবে কেন? নিধন না করেও শক্তির আরাধনা করা যায়। পথ দেখিয়ে দিলেন মা। আজও অনুসৃত হয় সেই মত। প্লেগ-মহামারীতে কাজ করতে অর্থাভাবে স্বামীজী একবার ভারী বিচলিত। চাইছেন, বেলুড় মঠ বিক্রি করে দিতে। মা বললেন, কাজ কি মাত্র একটা যে, সেই কাজের জন্য মঠ বিক্রি করে দিতে হবে! এই হলেন শ্রীমা সারদা। নরনারায়ণ সেবা করতে গেলে যে ঠিক কী করতে হবে, কীভাবে রক্ষণশীলতা কাটিয়ে সমাজের সামগ্রিক হিতে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে, প্রতি পদক্ষেপে তা দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন সংঘজননী।

[আরও পড়ুন: হাতের রেখায় M অক্ষর কীসের ইঙ্গিত? জেনে নিন জ্যোতিষীদের বক্তব্য]

আর ঠিক এইখানে তিনি স্বতন্ত্র। শক্তিস্বরূপা তিনি সাক্ষাৎ মহামায়। কিন্তু এবার তাঁর লীলা অন্যরকম। তাঁর মধ্যে খুঁজলে পাওয়া যাবে প্রাচীন ভারতকে। আবার তাঁর মধ্যেই নিহিত ছিল নতুন ভারতের পদধ্বনিও।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement