শুকদেব গোস্বামী: ভক্তের অভিলাষ, ভগবান যেন আরও নিবিড় করে ধরা দেন তার প্রতি মুহূর্তের যাপনে, মিশে থাকেন তার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটির সঙ্গে। শ্রীজগন্নাথের (Jagannath) ‘ঘোড়ালাগি বেশ’ ভক্তের সেই আকাঙ্ক্ষার অনুপম উপস্থাপনা। জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা: এই ত্রিদেব বরাবরই রকমারি পোশাকে সজ্জিত হতে ভালবাসেন। সেই বর্ণিল ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এখন তাঁদের পুজোপচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
‘ঘোড়ালাগি বেশ’-এর সারকথাটি হল, শীতের (Winter) ঋতুতে ত্রিদেব উষ্ণ পোশাক পরবেন। মানুষের সমাজে শীতে তো উলের পোশাক পরাই রীতি। তাহলে জগতের নাথ-ই বা কেন কষ্ট পাবেন শীতের কামড়ে? শ্রীগীতায় ভগবান নিজের মুখেই তো বলেছেন, মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ – অর্থাৎ সেই পরম ব্রহ্মেরই সনাতন অংশ জীব হয়ে প্রকৃতিতে অবস্থান করছে। সেই সাধারণ জীবের এক অংশ হয়ে মানুষ যদি শীতে কষ্ট পায় আর গরম পোশাকে শীত নিবারণ করে, তবে যাঁর অংশ থেকে তার উৎপত্তি, সেই ঈশ্বরকে কেন সে শীতের সামনে উন্মুক্ত ফেলে রাখবে! ভগবান যেমন তাঁর ভক্তকে পৃথক জ্ঞান করেন না, তেমনই প্রকৃত ভক্তও ভগবানকে পৃথক সত্তা বলে অনুভব করেন না। আপন আরাধ্যকেও তাই ভক্তজন নিজের জীবনছন্দে মিশিয়ে দেন। ভগবানের সেবা দেওয়া থেকে শয়নের যে রীতি – ভক্ত-ভগবানের এই অচ্ছেদ্য অনুভব থেকেই তার জন্ম। যার সম্প্রসারিত রূপটি আমরা পাই প্রভু জগন্নাথের ‘ঘোড়ালাগি বেশ’ ধারণে।
[আরও পড়ুন: Puri Jagannath Temple: চলতি বছরের শেষে ৩ দিন বন্ধ থাকবে পুরীর জগন্নাথ মন্দির, ঘোষণা কর্তৃপক্ষের]
ভক্তের কল্পনায় তাই ত্রিদেব সন্ধেয় গরম পোশাক পরেন। শাস্ত্রীয় বিধান মেনে, প্রতিদিন তাঁদের পোশাকের রং বদলে বদলে যায়। সোমবারের রং ধূসর। মঙ্গলবারের পোশাকের রং ‘বড়পাতিয়া’ নামে পরিচিত। পাঁচটি ভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটে। বুধবারের জন্য ধার্য রং নীল (Blue)। বৃহস্পতিবার হলুদ। শুক্রবার সাদা, শনিবার কালো, আর রবিবার লাল। সপ্তাহজুড়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এক-একটি রং নির্ধারক হয়ে ওঠে। ‘মার্গশিরা’ মাসের ঠান্ডাই সবচেয়ে জব্বর। তাই ‘মার্গশিরা শুক্লাষষ্ঠী’ থেকে ‘মঘা শুক্লপঞ্চমী’ তিথি পর্যন্ত এই ‘ঘোড়ালাগি বেশ’ উদযাপিত হয়।
[আরও পড়ুন: জানেন, অগ্রহায়ণ মাসে কোন দেবদেবীর পুজো করলে ভাগ্যোন্নতি হয়?]
শ্রীজগন্নাথ এই জগতের পালনহার। তিনিই ভক্তের শেষ আশ্রয়, সুখ ও দুঃখের চিরস্থায়ী সঙ্গী। তাঁর অনুপম লীলার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা অসম্ভব। ভক্তেরা সেই দুর্জ্ঞেয় লীলাময়তা ভেদও করতে চায় না। ভক্তের লক্ষ্য, শুধু আস্বাদন করে যাওয়া। ভক্ত ও ভগবানের এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটি আরও মধুর হয়ে ওঠে, যখন আমাদের লৌকিক জীবনের ছায়া তাতে পড়ে। শ্রীজগন্নাথের রসগোল্লা প্রীতির কথা সুবিদিত। তিনি খাদ্যরসিক। জ্বর হলে প্যারাসিটামল সেবন করেন। এইভাবে, প্রতিটি অনুভবে, ভগবান হয়ে ওঠেন ভক্তের নিকটবর্তী। পোশাকের প্রশ্নেও যে তিনি রামধনুর মতো মায়াবিস্তারী, তাও আমাদের জানান দেয় এই ‘ঘোড়ালাগি বেশ’। শীতের পোশাকের ঝলমলে ওম ত্রিদেবকে ঘিরে রাখুক, ভক্তের কাছে এর বেশি পাওনা আর কী?