কৃশানু মজুমদার: ফ্ল্যামবয়েন্ট ইমরান খান থেকে আভিজাত্যে মোড়া সুনীল গাভাসকর। হালআমলের হার্টথ্রব বিরাট কোহলি থেকে বাবর আজম। যুগের সঙ্গে সঙ্গে মুখ বদলেছে তারকাদের। বদলে গিয়েছে ক্রিকেটের ফরম্যাট। টেস্ট ক্রিকেট থেকে টি-টোয়েন্টি, গতি এসেছে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে।
মাঠের মতো পালাবদল ঘটেছে ধারাভাষ্য জগতেও। রেডিওর চৌখুপি থেকে টিভি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লাইভ ধারাভাষ্য--আমূল বদলে গিয়েছে ক্রিকেট শ্রবণের মাধ্যম-ও।
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ধারাভাষ্য জীবনে ক্রিকেটের বিবর্তন দেখা প্রদীপ রায় বলছেন, "ইস্ট-মোহন ম্যাচের মতোই ভারত-পাক ম্যাচ অর্থবহ ভূমিকা বহন করেছে আমাদের সমাজে। ইস্ট-মোহন ম্যাচে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় শহর। ভারত-পাক ম্যাচ এক করে দেয় গোটা দেশকে।''
[আরও পড়ুন: মার্করামদের নাকানি-চোবানি খাওয়াল নেদারল্যান্ডস, বিপর্যয় এড়িয়ে জয় প্রোটিয়াদের]
সুনীল গাভাসকরের সঙ্গে প্রদীপ রায়।
দেখতে দেখতে আরও একটা ভারত-পাক ম্যাচ আজ। কলকাতা থেকে বহু দূরের নিউ ইয়র্কে রোহিত শর্মার টিম ইন্ডিয়ার মুখোমুখি বাবর আজমের পাকিস্তান। সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে ক্রিকেটের মহাযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের ঢেউ আছড়ে পড়ছে দুই দেশে। দুরুদুরু বুকে কাঁপছেন দু-দেশের সমর্থকরা।
মহা ম্যাচের আগে নিজের ধারাভাষ্য জীবনের বহু দেখা রক্তের গতি বাড়িয়ে দেওয়া ম্যাচ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নস্টালজিক প্রদীপ। স্মৃতির পাতা উলটে বলে চলছিলেন তিনি, ''প্রথম যখন বাংলায় ধারাভাষ্য দেওয়া শুরু করেছিলাম, তখন কোন্নগরে থাকতাম। ইডেনে ভারত-পাক ম্যাচ থাকলে সকাল সকাল উঠে বর্ধমান বা ব্যান্ডেল লোকাল চেপে হাওড়া স্টেশনে নামতাম। সেখান থেকে বাসে করে এসপ্ল্যানেড। তারপরে হাঁটতে হাঁটতে ইডেন। ট্রেনে-বাসে চেপে আসার সময়ে সহযাত্রীদের কথায় এই ম্যাচের উত্তেজনা-আবেগ অনুভব করতাম। ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় সেই অভিজ্ঞতা খুব কাজে লাগত।"
তখনও কলকাতা এত বেগবান হয়নি। গতির ঝাপটা ওলট পালট করে দেয়নি সমাজ-সাম্রাজ্যকে। সময়টা সত্তর দশকের মাঝামাঝি। বাংলার রাজনীতি-সমাজ গনগনে। ইডেনে তখন ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলও হত। ক্রিকেট-ফুটবলে ছাপ থাকত সমাজের সর্বস্তরের আদি-অকৃত্রিম আবেগের।
'ইডেন উদ্যান থেকে বলছি,' অজয় বসুর দৈবকণ্ঠ শোনার অপেক্ষায় থাকতেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। তখন ছিল রেডিওর যুগ। পরবর্তীতে টেলিভিশন বিনোদনের মূল মাধ্যম হয়ে উঠলেও, জনপ্রিয়তা অটুট রেখেছিল রেডিও। ইডেনে টেস্ট ম্যাচ হলে অনেক বাড়িতেই চোখ থাকত টিভি সেটে আর কান থাকত রেডিওয়।
এখনকার মতো চার-ছক্কার গর্জনে বাইশ গজ কাঁপত না। ঢিমেতালের টেস্ট উপভোগ করতেন সমর্থকরা ধৈর্যের মৌতাত নিয়ে। টানা পাঁচদিন খেলা হত না। প্রথম তিন দিনের পরে দেওয়া হত বিশ্রাম। ওইদিন ক্রিকেটাররা নিউ মার্কেট চত্বরে ঘুরতেন। পাপারাজ্জির ক্যামেরায় ধরা পড়ত সেই ছবি।
ফেলে আসা সময়ের ক্ষণ-অনুক্ষণ, পল-অনুপল জুড়ে জুড়ে প্রদীপ বলছিলেন, "আমি অজয়দার (বসু) সঙ্গে কমেন্ট্রি করেছি। এখন অশোক দিন্দা-স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়দের সঙ্গে ধারাভাষ্য দিই। অনেকটা সময় দেখেছি। ক্রিকেট অ্যাপ্রোচে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ডারবানে অনুষ্ঠিত ভারত-পাক ম্যাচের কথা মনে পড়ছে। ভারত ১৪১ রান করে ২০ ওভারে। রান তাড়া করতে নেমে পাকিস্তানও একই রান করে। বোল আউটের মাধ্যমে ভারত শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জেতে। এখন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ১৪০ সেরকম রানই নয়। ২০০ রান উঠে যাচ্ছে এখন। সেই স্কোরও যথেষ্ট নয়।"
ভারত-পাক ম্যাচ ক্রিকেটের সবথেকে বড় বক্স অফিস। এই ম্যাচ থেকে লক্ষ্মীলাভ হয়। আবার আবেগের ঢেউ ওঠে মনে। বর্ণময় সব চরিত্র। ঠিক যেন রূপকথার রাজপুত্র সব। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সরণি হেঁটে প্রদীপবাবু বলছিলেন, "আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ভারত-পাক ম্যাচের গুরুত্ব যে কোনও টুর্নামেন্টের ফাইনালের থেকেও বেশি। এই ম্যাচ জিতলে তা ফাইনাল জেতারই শামিল।"
ক্রিকেট-ফুটবলের পাশাপাশি অন্য খেলারও ধারাভাষ্য দিয়েছেন বাংলায়। দীর্ঘ কেরিয়ারে ঐতিহাসিক সব ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন। নির্বাসন কাটিয়ে ক্রিকেটের মূলস্রোতে কেপলার ওয়েসেলসের দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্যাবর্তন এখনও তাঁর চোখের সামনে ভাসে, "সেবার ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ ছিল ইডেনে। আমরা বাংলায় কমেন্ট্রি দিচ্ছিলাম। জুলু ভাষায় কমেন্ট্রি দিতে এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকজন। সেটাই ছিল জুলু ভাষায় প্রথম ধারাভাষ্য। বাংলায় ধারাভাষ্য বহু আগে থেকে চলছে শুনে ওঁরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।"
ইডেন আর সেলিম মালিকের রোম্যান্স যেন মান্না দের সেই বিখ্যাত গান, 'হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে'। হারতে থাকা ম্যাচ একাই জিতিয়ে দিয়েছিলেন সেলিম মালিক। সেই ম্যাচ চলাকালীন পাকিস্তানের ব্যাটিং অর্ডার পুরোটা বদলে দিয়েছিলেন ইমরান খান। অনেকটাই নিচের দিকে পাঠানো হয় সেলিম মালিককে। ইমরান আউট হওয়ার পরে ব্যাট করতে নামেন সেলিম মালিক। পাক অধিনায়ক আউট হয়ে ফেরার সময়ে একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন ম্যাচ হারছেন। সেলিম মালিক মাঠে নামার সময়ে জিজ্ঞাসা করেন," কী করব?" সেলিম মালিকের দিকে না তাকিয়েই ইমরান হাতের ইশারায় বলেছিলেন, যা পারো করো। হেরে বসা ম্যাচ সেলিম মালিক একাই জিতিয়ে দেন।
এহেন সেলিম মালিককে অনূর্ধ্ব ১৯ টেস্ট ম্যাচ খেলতে দেখেছিলেন প্রদীপবাবু। সেই টেস্টের ধারাভাষ্য দেওয়ার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, "১৯৭৯ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ ভারত ও পাকিস্তানের সেই টেস্টে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত ১০২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন। বিষাণ সিং বেদি ছিলেন ভারতীয় দলের ম্যানেজার। পরবর্তীকালে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে ওয়াসিম জাফরের ডাবল হান্ড্রেড দেখেছি। ইডেনে রাহুল দ্রাবিড় আর ভিভিএস লক্ষ্মণ-এর সেই রূপকথা দেখেছি।"
প্রায় দেড়শো জন সহ-ধারাভাষ্যকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। ২০১৫-য় ক্রিকেটের ব্লকবাস্টার ম্যাচে জুড়ে গিয়েছিল রুপোলি পর্দার মেগাস্টারও। কীভাবে? স্মৃতির ঢেউয়ে ভিজে প্রদীপ বলছিলেন, "আমাদের দুটো বুথ পরেই অমিতাভ বচ্চন হিন্দিতে কমেন্ট্রি দিচ্ছিলেন। শুনেছিলাম নিজেকে তৈরি করার জন্য হর্ষ ভোগলেকে সঙ্গে নিয়ে অনুশীলন করেছেন ম্যাচের বহু আগে থেকে। অনেকে পরে রসিকতা করে বলেছিলেন, অমিতাভ বচ্চন কমেন্ট্রিতে এলে অনেকেরই চাকরি চলে যাবে।"
বাংলা ভাষার সাবলীল প্রয়োগে নজর কেড়েছেন। তাঁর বাক প্রতিভায় মুগ্ধ বাঙালি শ্রোতা। বাংলা ধারাভাষ্যে আরও 'প্রদীপ' জ্বলার অপেক্ষায় বর্ষীয়ান ধারাভাষ্যকার।