বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: ধ্রুব বন্দোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ (Karnasubarner Guptodhon) বাংলা ছবির বাজারে সবচেয়ে বড় ওপেনিং পেয়েছে অ্যাডভান্স বুকিং-এর ক্ষেত্রে এমনটাই দাবি প্রযোজনা সংস্থার। এবং কোভিড পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ফ্র্যাঞ্চাইজির সবচেয়ে অভিনব দিক হল বিনোদনের সঙ্গে বাংলার ইতিহাসকে জুড়ে অরিজিনাল ভাবনা থেকে তৈরি হওয়া তিন চরিত্র। যা এখন বাংলার বুকে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
সোনাদা অর্থাৎ সুবর্ণ সেন, আবির এবং ঝিনুক সিনেপ্রেমী বাঙালির পরিচিত। ইতিহাসের গবেষক তথা ট্রেজার-হান্টার বাঙালি বুদ্ধিদীপ্ত সুবর্ণ সেন মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে তাতে আর সন্দেহ নেই। এবং ব্যোমকেশের ধুতি পাঞ্জাবি ছেড়ে আজকের আধুনিক বেশে সুবর্ণ সেন-রূপী আবির চট্টোপাধ্যায় (Abir Chatterjee) এই চরিত্রের জন্য পারফেক্ট সেটা আরও একবার বোঝা গেল ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ দেখতে গিয়ে।
এই ছবির ক্যাচ হল, একটা সিরিয়াস বিষয়কে বাঙালি সেন্টিমেন্টে মুড়ে, সেটাতে বাঙালি রসবোধ মিশিয়ে একটা মুচমুচে মিষ্টি, ছোট সাইজের, ভিতরে ফুলকপি দেওয়া বাঙালি সিঙ্গারার মতো করে পেশ করা। যারা অবাঙালি ঝাল, জিরে, ভাজা মশলা দেওয়া বড় বড় সিঙ্গারা খেতে অভ্যস্ত তাঁরা এর স্বাদ বুঝবেন না। একেবারে গোদা বাঙালি সেন্টিমেন্টে ভর করে, তাতে ইতিহাস এনে , অ্যাডভেঞ্চার এনে প্রপার প্যাকেজ। এবং তার জন্য ‘ব্রহ্মাস্ত্র’র মতো চারশো কোটি টাকা খরচ করতে হয়নি।
[আরও পড়ুন: ‘কাছের মানুষ সহজে পাওয়া যায় না’, জন্মদিনে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অকপট প্রসেনজিৎ]
‘ব্রহ্মাস্ত্র’র সঙ্গে এ ছবির তুলনা আনতেই হল, কারণ যতই ব্যবসা করুক অরিজিনালিটির দৌড়ে এগিয়ে থাকবে বাংলার সোনাদা। কারণ কনটেন্টের বিচার করতে গেলে অয়ন মুখোপাধ্যায়কে হারিয়ে দিয়েছেন পরিচালক ধ্রুব বন্দোপাধ্যায় (Dhrubo Banerjee)। কারণ সোনাদার চরিত্রটা বাংলার মাটিতে রুটেড এবং সেখান থেকেই তার উৎপত্তি। ব্যক্তিগত ভাবে আমার তাই মনে হয়।
এবারের গুপ্তধনের সন্ধান করতে গিয়ে যেমন দৌড়ঝাঁপ অনেক বেশি, সেই সঙ্গে আছে কমেডির মেজাজ। সেকেন্ড হাফে মেন ভিলেন এন্ট্রি নেওয়ার পর সোনাদার সঙ্গে তার টক্কর দেখতে দেখতে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে। বিশেষ করে রজতাভ দত্ত এবং সেই সঙ্গে বলতে হয় অর্জুন চক্রবর্তীর (Arjun Chakraborty) কমিক টাইমিংয়ের কথা। পুরুলিয়া, মালদার নানান আনএক্সপ্লোর্ড লোকেশন দেখতে পাওয়াটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। এবং আমার মতো তেমন ইতিহাস না জানা মানুষ, ছবি দেখে বাধ্য হয়েছি গুগলের সাহায্য নিয়ে রাজা শশাঙ্ক সম্পর্কে আরও জানতে। কারণ ছবিতে টানা এত ইনফরমেশন ভাল করে ঠাওর করা যায় না।
রোহিতাশ্বগড়ের মতো রোহতাজগড় সত্যি আছে আমাদের ম্যাপে। বিহারের রোহতাসে যে রোহতাজগড় দুর্গ সেটার সঙ্গে রাজা শশাঙ্কর একটা যোগ আছে সেটা গুগলে সার্চ করলেই পাওয়া যায়। আর এটাই বোধহয় পরিচালকের সাফল্য। একেকজন দর্শককে একেকভাবে প্রভাবিত করবে। ঝিনুক, আবির সোনাদার খুনসুটি নিয়ে বাড়ি যাবে কেউ আর কেউবা একটু ইতিহাসটা ঝালিয়ে নিতে চাইবে। পর্দার পিছনে রয়েছেন ধ্রুব বন্দোপাধ্যায় আর তাঁর দূত হিসেবে পর্দায় দেখতে পাচ্ছি আবির চট্টোপাধ্যায়ের ক্যারিশ্মা। আবির ছাড়া আর কেই বা হতে পারতেন সুবর্ণ সেন!
আর কেইবা টক-ঝাল-মিষ্টি চানাচুরের মতো পাঁচফোড়ন হয়ে উঠতে পারত ইশা (Ishaa Saha) অভিনীত ঝিনুক ছাড়া। তবে হ্যাঁ, ইতিহাসজনিত তথ্যের ডোজ এবং প্রেজেন্টেশন নিয়ে আরও একটু ভাবনাচিন্তা করা যেতে পারে। আমরা জানি সোনাদা অনেক কিছু জানে, কিন্তু সব পরিস্থিতিতে পারফেক্ট হলে সিনেমা দেখার মজাটাও চলে যায়। মানুষ হিসেবে আমরা তো আমাদের মতো মানুষ দেখতে চাইব যার একটু আধটু ভুল হয়। না হলে রিলেট করব কী করে?
আর ভুলে গেলে চলবে না তারই মধ্যে রয়েছে আহ্লাদি বাঙালিয়ানার ডোজ। সেটা কমলে আসবে দ্রুতি এবং মেদহীনতা। আবিরলালের চরিত্রকে আরও একটু পরিণত করা যেতে পারে, হাজার হোক আইন পাশ করা আজকের দিনের যুবক। তবে একটা কথা ভাল করে বুঝে নিন, ঠাকুর দেখতে-দেখতে খালি পেটে এই ছবি দেখতে যাবেন না ভুলেও। খিদে বেড়ে যাবে!
সিনেমা- কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন
পরিচালক- ধ্রুব বন্দোপাধ্যায়
অভিনয়- আবির চট্টোপাধ্যায়, ইশা সাহা, অর্জুন চক্রবর্তী, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত , সৌরভ দাস, বরুণ চন্দ , কিঞ্জল নন্দ।