নির্মল ধর: প্রচারপত্রে বলা হচ্ছে ‘সায়ক’ (Sayak Theatre Group) নাট্যদলের নবতম প্রযোজনা ‘আত্মজন’ বাস্তবকে আবিষ্কার করার আন্তরিক নাটক। কিন্তু উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের লেখা নাটকটি দেখার পর বলতেই হচ্ছে, শুধু আবিষ্কার নয়, ‘আত্মজন’ বাস্তবকে উপলব্ধি করার নাটকও। কারণ প্রধান চরিত্র মধ্যবয়সী বসন্ত পঙ্গু অশীতিপর পিতার প্রতি হয়তো একটু বেশিই দুর্বল। তাঁর চিকিৎসা ও সেবার দিকে বসন্তের তীক্ষ্ণ নজর। এমনকী এর জন্য নিজের অসুস্থ শিশুকন্যাকে কিঞ্চিৎ অবহেলাও করেছে সে। আবার এই বসন্তই আবার একটু বদরাগী, স্ত্রীর প্রতি উপযুক্ত ভালবাসা দেখায়নি। সংসারে তাঁর প্রথম ও শেষ প্রায়োরিটি বৃদ্ধ বাবা হেমন্ত মুখ্যোপাধ্যায় (প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক)। অথচ বসন্ত মানুষটি যথেষ্ট সৎ, বিবেকবান, সংবেদনশীল, পরোপকারী। স্বামী হিসেবে মোটেই অযোগ্য নন। বাবা হিসেবেও খুবই স্নেহশীল। বসন্তর এই পিতৃভক্তিতে অতীষ্ট তাঁর স্ত্রী রিনা। মেয়ে পুতুলকে নিয়ে সংসার ছাড়ার পাশাপাশি ডিভোর্সের নোটিসও পাঠিয়েছে। নাটকের শুরু এই ঘটনা দিয়েই।
নাটকের এক দৃশ্যে পঙ্গু বৃদ্ধ বাবা ছেলে বসন্তর উদ্দেশ্য বলে উঠেছেন “স্ট্যান্ড আপ অন দ্য বেঞ্চ…”! মিলনের পরিবেশে তখন হেমন্ত-বসন্ত একাকার। নাট্যকার নিম্নবিত্ত সংসারের ছবিও মঞ্চে তুলে ধরেছেন বাড়ির আয়া সরমা, তার স্কুটার চালক স্বামী মদ্যপ মাখন এবং একমাত্র সন্তান সোনার গল্পকে কেন্দ্র করে। দারিদ্র্য যে মানুষকে অসৎ করে, তা সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা অস্তিত্ব রাখার তাগিদেই অমানুষ হয়ে যাই, বেঁচে থাকার জন্যই কূটকচালি করি, ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যই দালালি করি। এটাও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন নাট্যকার। আসলে আমরা নিজস্ব স্বার্থেই এগিয়ে চলি, অন্যের দিকটা ভাবি না, ভাবতে পারি না, চাইও না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধগুলো হারিয়ে ফেলেছি, জলাঞ্জলি দিয়েছি মানবিকবোধ, সহনশীলতা এবং সহমর্মিতা। শুধুই নিজের স্বার্থ দেখে জীবনকে এগিয়ে নিতে গিয়ে যে প্রকৃত জীবন থেকে যে পিছিয়ে পড়ছি – সেটা বুঝতেই পারছি না। দিশেহারা হয়ে দুষছি নিজেকেই।
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে, সরল ভঙ্গিতে চলমান জীবনের সারসত্যটি প্রকাশ করেছেন। ঠিক একই সুরে তালে লয়ে নাটকটিকে মঞ্চে বেঁধেছেন পরিচালক মেঘনাদ ভট্টাচার্য। নাটকের অনেকগুলি জায়গায় কমেডির ছোঁয়া আছে। সেগুলোকে সুন্দর ব্যবহার করেছেন তিনি। বিশেষ করে শিল্পীদের অভিনয়ের ছোট্ট ছোট্ট ছোঁয়ায়। আবার স্মৃতিভ্রষ্ট বৃদ্ধ বাবার মুখ দিয়ে অতীতের কিছু ঘটনার কথাও শুনিয়েছেন। বিরতির আগের দৃশ্যে যেখানে ছেলে বসন্ত বাবার কোলে মাথা রেখে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে বলছে, “আমি সংসার চাই, আমি শান্তি চাই, আমি পুতুলকে চাই”, সেখানে সমীরণ ভট্টাচার্য এবং বিশ্বনাথ রায় নিজেদের প্রাণঢালা অভিনয়ে নজির রেখেছেন।”
[আরও পড়ুন: কেমন হল রহস্যে মোড়া ‘হ্যালো’ ওয়েব সিরিজের শেষ সিজন? পড়ুন রিভিউ]
খুবই ভাল লেগেছে মাখনের চরিত্রে প্রসেনজিৎ কুণ্ডু এবং তাঁর স্ত্রী সরমার ভূমিকায় ইন্দ্রজিতা চক্রবর্তীকে। বসন্তের স্ত্রী রিনার চরিত্রে রূপসা ভট্টাচার্য ব্যক্তিত্ব নিয়েই কাজ করেছেন। অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে রান্নার মাসি(ভারতী দাস), পতিত পাবন(সুব্রত ভাওয়াল), ডাক্তার সেন(পরিমল চক্রবর্তী), পাঁচু (উত্তম দে) চরিত্রের শিল্পীরা যথেষ্ট ভারসাম্য রেখে অভিনয় করেছেন নাটকের থিমকে স্মরণে রেখে। ‘সায়ক’ অধিকাংশ প্রযোজনাতেই সাধারণ দর্শককে মানসিক আনন্দ দেওয়ার ব্যাপারটায় নজর রাখে, একই সঙ্গে সামাজিক দায়বোধের পরিচয়ও দেয়। ‘আত্মজন’ সেই উদ্দেশ্য থেকে সরেনি। বরং আরও বেশি ঘনবদ্ধ হয়ে বেসিক মূল্যবোধের জয়গানই গেয়েছে, যা এই মুহুর্তের একান্ত প্রয়োজন। তবে বাংলায় ঋতুর পর্যায় গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। এই তালিকা অনুযায়ী ছেলের নাম হেমন্ত ও বাবার নাম বসন্ত হলেই বোধহয় ভাল হত।