অর্ণব আইচ: দেড় মাস পরও মোটিভ ঘিরে ধন্দ। আর জি কর-কাণ্ডে সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও খুনের চার্জশিট দাখিলের রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না সিবিআই। শেষ পর্যন্ত কলকাতা পুলিশের দেখানো পথে চলেই সিবিআইকে চার্জশিট দাখিল করতে হতে পারে বলে অভিমত ওয়াকিবহাল মহলের।
আর জি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর মাত্র চার দিন নিজেদের হেফাজতে রেখে মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে জেরা করতে পেরেছিল কলকাতা পুলিশ। গত ১৩ আগস্ট এই ধর্ষণ ও খুনের তদন্তভার নেয় সিবিআই। এর পর থেকে দুসপ্তাহ হেফাজতে থাকাকালীন সঞ্জয়কে টানা জেরা করেন সিবিআই আধিকারিকরা। এমনকী, বেশ কিছু তথ্য যাচাই করতে সিবিআই সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের পলিগ্রাফ পরীক্ষাও করান। কিন্তু তাতেও নতুন কোনও তথ্য সিবিআই আধিকারিকরা হাতে পাননি বলে সূত্রের খবর। অথচ নতুন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণ ও খুনের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দাখিল করতে হবে। সেই মতো অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে শিয়ালদহ আদালতে এই মামলার চার্জশিট দাখিল করার কথা।
সিবিআইয়ের সূত্র জানিয়েছে, আর জি কর হাসপাতালের চারতলায় সেমিনার হলের ভিতর থেকে তরুণী চিকিৎসকের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার পর পরই হলের উলটোদিকের একটি ঘর ভেঙে ফেলার কারণে সিবিআইয়ের ধারণা হয়, তাঁর দেহটি সেমিনার হলে পাওয়া গেলেও ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাস্থল অন্য জায়গায়। সিবিআইয়ের কাছে এমন তথ্য আসে যে, ওই ভেঙে ফেলা ঘর, অথবা ৬ বা ৮ তলার কোনও ঘরে ওই নির্যাতিতাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর উপর অত্যাচার করা হয়। মারধর করার পর অচেতন অবস্থায় সেমিনার হলে তাঁকে রেখে দিয়ে পালায় দুষ্কৃতীরা। এর পর সঞ্জয় রাই হলের ভিতর গিয়ে তাঁর উপর যৌন অত্যাচার চালায়। শেষ পর্যন্ত তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। কিন্তু ৪০ জনের উপর চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্মী, নার্স, ডাক্তারি পড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বহু ‘তথ্য’ সিবিআইয়ের সামনে এসেছে, যেগুলি বিভ্রান্তিমূলক বলেই দাবি সিবিআইয়ের। ফলে সেমিনার হল ছাড়া আর জি করের অন্য কোনও ঘরে তরুণী চিকিৎসককে মারধর অথবা অত্যাচার করা হলেও সেই ঘরটি সিবিআই শনাক্ত করতে পারেনি। তাই এখনও পর্যন্ত সিবিআইয়ের মতে, সেমিনার হল ছাড়া অন্য কোনও জায়গা যে ঘটনাস্থল, সেই প্রমাণ এখনও মেলেনি। সেই ক্ষেত্রে কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্ত সঞ্জয় রায় যে একমাত্র অভিযুক্ত, তা নিয়েও ধন্দে সিবিআই। আবার সঞ্জয় ছাড়াও অন্য কেউ ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, এমন প্রমাণও সিবিআই পায়নি। এই ঘটনাটি যে গণধর্ষণ নয়, তা আদালতে ইতিমধ্যেই জানিয়েছে সিবিআই। তাই আদালতেও সঞ্জয় ছাড়া সরাসরি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় অন্য কাউকে অভিযুক্তও করতে পারেনি সিবিআই। বরং মূল ‘ফোকাস’ থেকে সরে এসে কীভাবে অপরাধের তথ্য ও প্রমাণ লোপাট হয়েছে, এখন তার উপরই সিবিআই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
এদিকে, সিবিআইয়ের সূত্র জানিয়েছে, ধর্ষণের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করেও সিবিআই এখনও পর্যন্ত ধন্দে। সূত্রের খবর অনুযায়ী, নির্যাতিতার নখে থাকা টিস্যু, অভিযুক্ত সঞ্জয়ের জামাকাপড়, জুতো পরীক্ষার পর কেন্দ্রীয় ফরেনসিকের অভিমত, সঞ্জয় একা থাকার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু নির্যাতিতার দেহ থেকে যে তরল উদ্ধার হয়েছে, সেটিতে কোনও সিমেন বা শুক্রানু ছিল কি না, পরীক্ষার রিপোর্টের পর তা নিয়ে অনেকটাই ধন্দে সিবিআই। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, সিবিআই এ-ও নিশ্চিত যে, নির্যাতিতার উপর নারকীয় যৌন নির্যাতন হয়। আর আইন অনুযায়ীই সেই নির্যাতন ও ধর্ষণ সমার্থক। ওই যৌন নির্যাতনের মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রাই বলে দাবি সিবিআইয়ের। ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের পর সঞ্জয় শ্বাসরোধ করে নির্যাতিতাকে খুন করে বলে দাবি সিবিআইয়ের।
কিন্তু খুনের কারণ বা মোটিভ কী, প্রায় দেড় মাস তদন্তের পরও ধন্দে সিবিআই। সঞ্জয়কে টানা জেরা করে মোটিভ সম্পর্কে কোনও স্বচ্ছ ধারণা হয়নি সিবিআইয়ের। আবার জেরার মুখে যে অন্য কোনও অভিযুক্ত মূল ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, সিবিআই এমনও প্রমাণ পায়নি। কিন্তু আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করতে গেলে সেই চার্জশিটে মোটিভ বা এই নারকীয় অপরাধের কারণ সম্পর্কে আদালতকে জানাতে হবে। সঞ্জয়কে জেরা করে সিবিআই জানতে পেরেছে, ঘটনার রাতে সে প্রচণ্ড মদ্যপ অবস্থায় ছিল। ওই অবস্থায় সে সেমিনার হলে ঢুকে গিয়ে তরুণী চিকিৎসককে দেখতে পায়। তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। তরুণী বাধা দিলে তাঁকে মারধর করে অচেতন করে ফেলে সে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তরুণী রাতে অ্যালার্জি ও কাশির ওষুধ খান। সেই কারণে ঘুম ভাঙার পরও বিশেষ বাধা দিতে পারেননি। অচেতন অবস্থায় তাঁর উপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়। এর পর তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন করে সে। কিন্তু সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে কীভাবে পেশ করা হবে চার্জশিট, কীভাবেই বা একা তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তা নিয়ে এখনও সিবিআই ধন্দে। সেই ক্ষেত্রে দু’সপ্তাহ আগেও চার্জশিট পেশ নিয়েও ধাক্কা খাচ্ছে সিবিআই।