টলিউডের অন্দরের যৌন হেনস্তা, তার প্রতিরোধে পদক্ষেপ, নায়িকার নিজস্ব স্ট্রাগল এবং পুজোর ছবি ‘বহুরূপী’ নিয়ে শম্পালী মৌলিকের সঙ্গে কথা বললেন ঋতাভরী চক্রবর্তী (Ritabhari Chakraborty)।
পুজো রিলিজে কি মানুষের মন আছে? কী মনে হয়?
এর উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। কারণ, এমনিতে মানুষের মনখারাপ হয়ে রয়েছে। একটা প্রাণের, একটা মেয়ের এভাবে চলে যাওয়া, শহরের মাঝখানে, কাজের মধ্যেই যদি কারও সঙ্গে এমন হতে পারে তাহলে এ তো আমাদের যে কারও সঙ্গে হতে পারে। প্রথমে ভীতি, রাগ দেখেছিলাম, এখন মানুষের মধ্যে চরম হতাশা দেখছি। একমাস হয়ে গেল, প্রপার উত্তর নেই। মানুষ ভীষণভাবে চাইছে, কালপ্রিট ধরা পড়ুক। সেই জন্য মানুষ অন্য কোথাও ফোকাস করতে পারছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।
প্রতিবাদের পাশাপাশি কাজটাও জরুরি। সেটা বিশ্বাস করেন বলেই কি পাপুয়া নিউগিনি থেকে ফিরে এসে নিজেদের পুজোর ছবি ‘বহুরূপী’র প্রচারে যোগ দিলেন?
সত্যি বলতে আমাদের প্রচারে অনেকরকম পরিকল্পনা ছিল। টিজার লঞ্চে অনুষ্ঠানেরও প্ল্যান ছিল। কিন্তু উইন্ডোজ থেকে ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, অন গ্রাউন্ড এখন কোনও জমকালো অনুষ্ঠানের দরকার নেই, কারণ সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তা মানায় না। মানুষ কোনওরকম উদযাপনের মেজাজে নেই। কিন্তু ছবির মুক্তি যে পুজোয়, সে তো পূর্বনির্ধারিত। তাই ছবির বিষয়, কী বৃত্তান্ত সেটা নিশ্চয়ই মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। সেটা যথাসম্ভব এই পরিবেশ এবং আন্দোলনের মেজাজ নষ্ট না করে। কিন্তু এই পদ্ধতির তো নির্দিষ্ট কোনও ব্যাকরণ নেই। আমরা চেষ্টা করছি অত হইহই না করে প্রচার পর্ব সারতে। ‘বহুরূপী’ খুব খেটে, অনেকদিন ধরে শুট করে বানিয়েছি আমরা। বিনোদন, নাটক সব আছে, লার্জ স্কেলের বাংলা ছবি এটুকু বলব।
উইন্ডোজ-এর সঙ্গে এটা আপনার তৃতীয় কাজ...
‘উইন্ডোজ’-এর সঙ্গে কাজ সবসময় আনন্দের। এটা আমার পরিবারের মতো। যেদিন নবান্নে গেলাম দিদিকে সেদিনও বললাম, গোটা ইন্ডাস্ট্রি অন্ধকারাচ্ছন্ন তা নয়। ভালো অভিজ্ঞতাও আছে। এখানে নন্দিতাদি-শিবুদার মতো মানুষ রয়েছেন। অন্যদিকে রানেদা (নিসপাল সিং) রয়েছেন। রাজ চক্রবর্তী বা জিৎদা-পরমব্রতদাদের হাউস রয়েছে। এসব জায়গায় আমরা প্রোটেক্টেড ফিল করি। কিন্তু কিছু পচা আপেলও রয়েছে, যে জন্য নাম খারাপ হয়। এদের অ্যাজেন্ডাই হল, মেয়েদের বিশ্বাস করানো যে কাজ পেতে কমপ্রোমাইজ করতে হবে। যারা অন্য পথ বেছে নিতে চায় তাদের ওরা ছবিতে নেয় না।
'বহুরূপী' সিনেমার শুটিংয়ে ঋতাভরী ও আবির
আবির চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার দ্বিতীয় কাজ এটা...টিজার দেখে মনে হল প্রেম-অভিমানের সম্পর্ক?
হ্যাঁ, ‘ফাটাফাটি’-র সময় থেকেই দর্শক আমার আর আবিরদার রসায়ন ভালোবেসে গ্রহণ করেছে। আমার-আবিরদার রিয়্যাল লাইফের বন্ধুত্ব-খুনসুটি পর্দায় ফুটে ওঠে, যেটা দর্শক দেখতে পায়। এই ছবিতে আমাদের প্রপার রোমান্স দেখবে দর্শক। বাবি আর পরি হিসাবে রয়েছি আমরা। বাবি পুলিশে কাজ করে, কাজের চাপ, টানাপোড়েন, দাম্পত্য, সারপ্রাইজ এলিমেন্ট সব মিলিয়ে দর্শকের ভালো লাগবে মনে হয়। পরি-বাবিকে প্রায় চোখে হারায়।
বিদেশ থেকে ফিরে ছবির প্রচারে যাওয়ার আগেই আপনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন সম্প্রতি, টলিউডের নারী-হেনস্তার তদন্তের স্বার্থে একটা কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে। বিষয়টা কি এতটাই গুরুতর মনে হয়েছে, যে ফিরে প্রথম কাজই এটা?
এতটাই গুরুতর। আমি বাইরে থাকাকালীনও প্রতিবাদের পাশেই ছিলাম। আমার মা, দিদি, ম্যানেজার, বন্ধুবান্ধবরা প্রায় রোজই মিছিলে গিয়েছে। প্রথমে আর জি কর-এর ঘটনা নিয়ে রোজই পোস্ট করছিলাম। মানুষও এত রেগে ছিল যে, প্রায় সব পুরুষের উপরই ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিল। আমি তখন বলেছিলাম যে, ভুলে গেলে চলবে না আসল শত্রুটা কে। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে আমরা যুদ্ধ করছি, যারা প্রিডেটর তাদের বিরুদ্ধে। বাইরে থেকেই দেখলাম, এখানে মোমবাতি মিছিল। যারা সেই সব মিছিলে হাঁটছে, তার মধ্যে এমন অনেক মুখ রয়েছে যাদের ব্যক্তিগতভাবে জানি, যে তারা টলিউডে মেয়েদের কোন চোখে দেখে, কী ব্যবহার করে! তখনই কাকতালীয়ভাবে হেমা কমিটির রিপোর্টটা বেরোয়। আমার সঙ্গে ওখানে তখন মালয়ালম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পুরো ইউনিট কাজ করছিল। ওরা কাছ থেকে সবটা দেখেছে। আমি আমার সহ অভিনেতার থেকে বিষয়টা বুঝি। আই ওয়াজ ভেরি ইমপ্রেসড উইথ দ্য হেমা কমিটি রিপোর্ট। বড় বড় অভিনেতাদের রিজাইন করতে বাধ্য করা হয়েছে, তাঁরা কিন্তু বেশ সরকার-ঘনিষ্ঠ। সেটা বড় পদক্ষেপ। এই ঘটনাটা আর শহরের এই আন্দোলন আমাকে আত্মবিশ্বাস-সাহস জোগায়। যেটা আমি শেষ আট-দশ বছরে পাইনি। এরা যদি এক হয়ে প্রতিবাদ করতে পারে, আমরা কেন পারব না! আমরা তো বাঙালি। তখন সহ-অভিনেত্রীদের উদ্দেশে ওই পোস্ট করেছিলাম যে, চলো এদের মুখোশ খুলে দিই। খুব পজিটিভ সাড়া পেয়েছিলাম ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে। প্রচুর ফোনও পেয়েছি, যাদের কাছে কমবয়সি অভিনেত্রীরা কমপ্লেন করেছে। যেখানে মেয়েরা স্পষ্ট কথা বলতে চেয়েছে তাদের হেনস্তা প্রসঙ্গে। এখন বড় বিষয় নিশ্চয়ই আর জি কর কাণ্ড, তার সঙ্গে নারী সুরক্ষার দিকটাও প্রচণ্ড জরুরি। হেমা কমিটির রিপোর্ট যখন বেরিয়েছে এই সময়ে, তখনই আমার মনে হয়, আমাদের এটা নিয়ে এগোতে হবে। নাউ আর নেভার। তাই আমি সিএমকে ট্যাগ করেছিলাম। ওদের ক্ষেত্রে সরকারের তরফে এই ধরনের যৌন হেনস্তার তদন্ত হয়েছিল। আমরা যতই দল বেঁধে প্রতিবাদ করি, সোশাল মিডিয়ায় লিখি, এগুলো অপরাধ। তাই এগুলোর বিরুদ্ধে ফরমাল ইনভেস্টিগেশন হওয়া দরকার।
[আরও পড়ুন: ‘৫ দিনের রোজগার অন্ন জোগায় বহু মানুষকে’, বিচারের দাবিতে অনড় থেকেও দুর্গাপুজো চান দেব]
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ তো বেশ ইতিবাচক।
হ্যাঁ, একদম। কমিটি ফর্ম হয়েছে টলিউডের অন্দরের যৌন হেনস্তার তদন্তের স্বার্থে। এবং উনি আমার অনুরোধ রেখেছেন যে, কোনও সরকারি, রাজনৈতিক বা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রভাবশালী মানুষ, কেউ নেই সেখানে। এই ধরনের ঘটনা অনেকে দেখেও দ্যাখে না। মানে, আমি তো করছি না, তাহলে আমার বলার কিছু নেই, এমন মনোভাব। অনেক প্রভাবশালী অভিনেতা বা প্রযোজক অনেক আগেই পদক্ষেপ নিতে পারতেন, কিন্তু নেননি। বিষয়টা ওই, যে তাঁরা তো করছেন না। আমার কাছে অনেক কথা শুনে দিদি খানিকটা অবাকও হয়েছেন। নটীদের সময় থেকেই এটা প্রচলিত ধারণা যে, অভিনেত্রী মানেই শারীরিকভাবে নিজেকে অনেক মানুষকে বিলিয়ে দিতে বাধ্য। এই ধারণা বদলাতে হবেই। শিক্ষক, চিকিৎসক বা অন্য পেশার মানুষ সে ঘুম থেকে উঠে কাজে যায়, কাজ থেকে ফল আশা করে। আমরা অভিনেত্রীরাও তাই
করি। কেন অভিনেত্রীদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হবে, আমাদের স্ট্রাগল আরও বেশি? একটা কাজ শেষ হলে, পরেরটা হবে কি না জানি না। কারণ, সেখানে কেমন পুরুষ থাকবে জানি না। প্রযোজক-হিরো কেমন হবে, এই আশঙ্কা কেন থাকবে প্রত্যেকটা প্রোজেক্টে! কমবয়সিদের তো আরও সমস্যা। তাদের কথা তো কেউ মানেই না। সেদিন দিদির সঙ্গে মিটিংয়ের পর আমি খুব নিশ্চিন্ত।
শুনলাম মুখ্যমন্ত্রীকে আপনি কিছু প্রভাবশালী প্রযোজকদের নামও জানিয়েছেন?
হ্যাঁ, আমি বলেছি। উনি কিছু প্রশ্নও করেছিলেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে, আমি দুজনের নামও বলেছি। সে বিষয়ে তদন্ত করা হবে বলে উনি জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, উনি আমাকে আরও বেশ কিছু প্রশ্ন করেন। তখন বলি যে, শোনা কথায় কাউকে দোষারোপ করব না। তদন্ত শুরু হলে, মেয়েরা যে অভিযুক্তদের নাম নেবে, সেখান থেকেই বেরিয়ে আসবে এরা কতটা দোষী। শুধু বদনাম শুনেছি বলেই, কারও নাম করতে চাই না। কমিটিটা এই জন্যও, যেন কোনও নির্দোষকে দোষী বানিয়ে বদনাম না করা হয়।
বিদেশ থেকে আপনার সেই পোস্টে টলিউডকে ‘সুগার কোটেড ব্রথেল’ বলেও উল্লেখ করেন আপনি। যেটা মারাত্মক। আপনি তো অনেক ছোট বয়স থেকে কাজ করছেন।নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার দিনগুলো কেমন ছিল?
ঠিকই মারাত্মক কথা, কিন্তু সত্যি। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলেছি। নিজেও অনেক বছর এটা বিশ্বাস করতে চাইনি। ভালোটাই দেখতে চেয়েছি। সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা কেরিয়ারের শুরুর দিকেই হয়েছিল, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র পর। যখন আমার কুড়ি-একুশ বছর বয়স। যখন আমি প্রতিষ্ঠিত নই, শুধুই পরিচিত মুখ। এমন পরিচিত মুখের বিপদ সবচেয়ে বেশি।
সবাই টার্গেট করতে শুরু করে তাকে। এটা যেন নর্ম ধরে নিয়েছে, যে কাজ পেতে গেলে আপস করতে হবে। সবাই যে সরাসরি বিছানায় যাওয়ার প্রস্তাব দেয় তা নয়। একজন বড় অভিনেতা এক ব্যক্তির মাধ্যমে আমাকে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রস্তাব দেন এবং আমি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। সেই বিষয়ে একজন সিনিয়র জার্নালিস্টের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলাম। সেই জার্নালিস্ট আমাকে বলেছিলেন যে, ‘এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করলে! ইন্ডাস্ট্রিতে থাকতে গেলে এটুকু তো মেনে নিতেই হবে। ওইরকম একটা মানুষ তোমাকে কাছে পেতে চাইছে!’ এমন শিক্ষিত মানুষের কাছে এটা আমি আশা করিনি। বলেই দিয়েছিলাম, এসব আমি পারব না। উনি বলেছিলেন, ‘তাহলে তুমি কবিতা লেখো, অভিনয় করে কাজ নেই।’ এটা আমার কাছে খুব হতাশাজনক ছিল।