সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া: বীণা বিনা বীনাপানি! বুধবার বসন্ত পঞ্চমীতে ঘরে ঘরে বীণাপানির (Saraswati Puja 2024) আরাধনা। কিন্তু এই বাদ্যযন্ত্রই আজ অতীত। ঋগ্বেদের মতো প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ থাকা এই বীণা আর এখন সেভাবে চোখেই দেখা যায় না। এই বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান গাওয়া বা শেখানো তো দূর অস্ত। তাই পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার মতো জেলার সদর শহরগুলিতে আর এই বাদ্যযন্ত্রের সেভাবে বিক্রিবাটা নেই। সঙ্গীতের শহর বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরেও এই বাদ্যযন্ত্রের সেভাবে দেখা মিলছে না। ফলে এই বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তানপুরাকে অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। এমনকী মৃৎশিল্পীরাও ভুল-ভ্রান্তিতে সরস্বতীর হাতে বীণার বদলে তানপুরা তৈরি করে দেন। আর সেই প্রতিমা বিক্রি হয়ে পুজো হয়ে যায়।
প্রাচীন মিশরে আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই বাদ্যযন্ত্রের উৎপত্তি বলে জানা যায়। এই বাদ্যযন্ত্র সর্বপ্রথম মিশরে তৈরির পাশাপাশি সেখানেই বাজানো হয়েছিল বলে কথিত রয়েছে। তবে পরবর্তীকালে সরস্বতীর হাতের এই বাদ্যযন্ত্র তার মধুর আওয়াজে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। কিন্তু আজ তার আর দেখা মেলে না। এমনকী সরস্বতী পুজোতেও। পুরুলিয়া শহরের নামোপাড়ার একটি বাদ্যযন্ত্র দোকানের মালিক চন্দ্রনাথ লাই বলেন, “আমাদের ১৭৮ বছর পুরনো দোকান। আমরা ষষ্ঠ প্রজন্ম এই বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা করছি। গত ৩০ বছর আমাদের দোকানে কোনও বীণা বিক্রি হয়নি। বাবার সময় হয়তো বিক্রি হয়েছিল।”
[আরও পড়ুন: অস্কারের পর ফের আন্তর্জাতিক মঞ্চে দীপিকা, এবার কোথায় দেখা যাবে নায়িকাকে?]
প্রাচীন এই বাদ্যযন্ত্র শিল্পকলার প্রতীক। দেশের সঙ্গীত চর্চার ইতিহাসে এই বাদ্যযন্ত্রের ঝঙ্কার বড়ই মধুর। বিষ্ণুপুরের রামশরণ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সুজিত গঙ্গোপাধ্যায় জানান, “বীণা বাজান কজন? এই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আঁতুড়ঘরেও তা আর পাওয়া যায় না।” হতাশা ঝড়ে পড়ে তাঁর গলায়। তাঁর কথায়, “বছরের পর বছর বিষ্ণুপুরের এই সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে আলমারি বন্দি হয়ে রয়েছে সেকালের বিশাল রুদ্রবীণা। আর তা সামনে আনা হয় না।” ধুলো জমতে শুরু করেছে ওই প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রে। বিষ্ণুপুরের বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী রাসবিহারী শর্মা বলেন, “বীণার আওয়াজ খুব মিষ্টি ও মিহি। কার্যত শ্রোতাদের কানে পৌঁছানো মুশকিল। রাগও প্রস্ফুটিত হয় বিলম্বিত লয়ে। তাছাড়া এই বাদ্যযন্ত্র শেখাও ভীষণ কঠিন। এই কারণেই কোনওদিনই এই বাদ্যযন্ত্র সাধারণ মানুষজনের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। আজকাল যে ধৈর্যরই বড় অভাব।”
পুরুলিয়ার মতো প্রান্তিক শহরে বরাত পেলে কলকাতা থেকে এই বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। শহর পুরুলিয়ার মধ্যবাজারে একটি বাদ্যযন্ত্র দোকানের মালিক শুভাশিস দে বলেন, “বরাত মিললে আমরা কলকাতা থেকে বীণা এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু এখন বছরে দুটো বিক্রি হয় এমন উদাহরণও কম। ইলেকট্রিক তানপুরা বার হয়ে গিয়েছে তাই আর বীণার কদর নেই। তাছাড়া এই বাদ্যযন্ত্র দোকানে রেখে বিক্রি করাও খুব কঠিন কাজ। বাদ্যযন্ত্রের নিচের অংশে থাকে লাউ। দোকানে রাখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।”
[আরও পড়ুন: ‘এভাবে দেশ এগোতে পারে না’, দিল্লিতে কৃষকদের উপর ‘নৃশংস হামলা’ নিয়ে সরব মমতা]
পুরুলিয়া শহরের বি বি দাস রোডের বাসিন্দা সঙ্গীত শিক্ষিকা তথা গায়িকা দেবারতী ঘোষ বলেন, “বীণার ব্যবহার আর আমাদের জেলায় সেভাবে দেখা যায় না। অনেকেই বীণার সঙ্গে তানপুরাকে গুলিয়ে ফেলেন। মৃৎশিল্পীরাও সরস্বতীর হাতে বীণার বদলে তানপুরা দিয়ে দেন। বর্তমান সময়ে এই বাদ্যযন্ত্র বাজানোর শিল্পীই ক্রমশ কমে আসছে।” এই শহরের বেহালা বাদক স্বরূপ চট্টোপাধ্যায়, আড় বাঁশি বাজানো অংশুমান চক্রবর্তী বলেন, “বীনা আজকাল চোখেই পড়ে না। বাদ্যযন্ত্র বাজানো তো দূর।”