সম্যক খান, মেদিনীপুর: কেউ চাইলেন পরিবারের সঙ্গে থাকতে, তো কেউ বললেন ১৪ বছর জেলবন্দি থাকা অবস্থায় পরিবারের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে। কেউ বাবাকে হারিয়েছেন তো কেউ মাকে। কারও আবার স্ত্রী পরিবার ছেড়ে চলে গিয়েছে। সন্তানকে মানুষ করার কেউ নেই। প্রায় সকলেই পরিবারের সঙ্গে জীবনের শেষ দিনগুলি থাকার কাতর অনুরোধ শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে মাওবাদী হামলার মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৩ জনের।
সাজা শোনার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন আসামিরা। মাওবাদী নেতা মনসারাম হেমরম ওরফে বিকাশ ও তার স্ত্রী মাওবাদী নেত্রী ঠাকুরমনি হেমরম ওরফে তারা বলেন, “বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছে। এটা রাষ্ট্র কর্তৃক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।” আদালত চত্বরেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরও। এ বিচার তারা মানেন না বলে দাবি তুলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এদিন মূলত আগে থেকেই জেলবন্দি আসামীদের ডাকা হয়েছিল। যদিও ১৩ জনের মধ্যে এই মামলাতে জামিন পাওয়া এক ব্যক্তি ইন্দ্রজিৎ কর্মকারও হাজির ছিলেন। প্রথমেই ষষ্ঠ অতিরিক্ত জেলা দায়রা বিচারক সালিম শাহী এক এক করে ১৩ জনের কাছ থেকে তাদের বক্তব্য জানতে চান। সেখানেই এক একজন তাদের পরিবারের বর্তমান করুন অবস্থার কথা বিচারকের সামনে তুলে ধরেন। বেশিরভাগই ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ঘটনার পর পর গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে জেলে আছেন। কেউ কেউ আছেন ১২ বছর। কেউই পরিবারের মুখ দেখতে পাননি। আসামিদের মধ্যে কানাই হাঁসদার কাতর আবেদন ছিল যে গ্রেপ্তারির পর স্ত্রী তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। বাড়িতে বয়স্কা মা ও তার সন্তান আছে। তার সন্তানকে মানুষ করার কেউ নেই। তাকে যেন তার মা ও সন্তানের কাছে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।
[আরও পড়ুন: ২০১৪-র ভোটে তৃণমূলের অ্যাকাউন্টে ‘গরমিল’! অরূপ বিশ্বাসকে তলব ইডির]
অপর বন্দি কাজল মাহাতো বলেন, “আমরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। ব্লক তৃণমূলের সম্পাদক ছিলাম। ছিলাম রেশন ডিলারও। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা আছে। অভাবের সংসারে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ীতে আছে। পরিবারের সঙ্গে থাকতে চেয়েছেন তিনিও। যদিও এদিন বিচারকের সামনে খুব বেশী বক্তব্য রাখেননি মাওবাদী নেতা বিকাশ ও তার স্ত্রী তারা।” বিকাশ বলেছেন, “যা বলার আগেই আদালতে বলেছি। এখন আর নতুন করে কিছু বলার নেই। বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা আছেন। আর স্ত্রী-সহ তিনি জেলেই আছেন।” মাওবাদী নেত্রী কল্পনা মাইতি তো আবার প্রশাসনের ষড়যন্ত্রের শিকার দাবি করে। সাজার পর তাকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখারই আবেদন করেছেন বিচারকের সামনে। এদিন সব আসামিই নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। বিচারক অবশ্য তাদের জানিয়ে দেন দোষী সাব্যস্ত যখন হয়ে গিয়েছে তখন একথা বলে লাভ নেই। সর্বোচ্চ শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড সেকথাও তিনি জানিয়ে দেন।
এপিডিআরের দুই নেত্রী স্বপ্না ও জয়শ্রী অভিযোগ তুলে বলেছেন, এই বিচার আমরা মানি না। অধিকার কেড়ে নেওয়ার এই বিচার মানব না। এটা কি পুলিশি রাজ? পুলিশ যেভাবে চার্জশিট সাজিয়ে দেবে সেভাবে বিচার হবে। এটা মানবতার লজ্জা। আমরা অবশ্যই উচ্চ আদালতে যাব। ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাজাপ্রাপ্ত আসামী মানস মাহাতোর স্ত্রী নমিতা মাহাতোও। তার অভিযোগ, “সুচিত্রা মাহাতো যে সংবাদমাধ্যমের সামনে দোষ স্বীকার করে নিল, তাকে ধরল না, তাদের নামে মামলা চলল না অথচ যারা খেটে খেত তাদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সাজা দিল। এটাই কি বিচার?”