বিশ্বদীপ দে: ফের বারুদের গন্ধ বাতাসে! ইউক্রেনের (Ukraine) আকাশে রুশ বিমানের কুটিল ছায়া ভেসে উঠতে দেখে স্তম্ভিত বিশ্ব। গত দু’বছর ধরে অতিমারীর সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্লান্ত সভ্যতা। তার মধ্যেই লেগে গেল যুদ্ধ। সেই সঙ্গে গুঞ্জন, এটা কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার ইঙ্গিত? আর সেই আশঙ্কার মধ্যেই নেট ভুবনে ভেসে উঠল একটি ছবি। ইউক্রেনের মেট্রো স্টেশনে কাছাকাছি এক তরুণ ও তরুণী। প্রেমিকাকে ছুঁয়ে থাকা প্রেমিকের এই ছবি আবারও বুঝিয়ে দিল, যুদ্ধের কালো মেঘকে মোটেই ডরায় না প্রেম। বিশ্বযুদ্ধ (World war) হোক বা গৃহযুদ্ধ, ভালবাসা নতুন করে ঝিলিক দিয়ে ওঠে মৃত্যুঘন যুদ্ধের কিনারে। এই লেখায় তার কয়েকটিকেই আমরা ফিরে দেখব।
মার্কিন ব্যান্ড ‘ইগলস’-এর একটি বিখ্যাত গানের লাইন ‘হোয়েন উই আর হাংরি লাভ উইল কিপ আস অ্যালাইভ’। খিদের সময়ও আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে ভালবাসা। দুর্ভিক্ষ হোক কিংবা মহামারী। অথবা যুদ্ধের সর্বগ্রাসী লেলিহান শিখা। ভালবাসাই তো বাঁচায়। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেই হয়তো বুকের ভিতর থেকে উজার করা ভালবাসা বেরিয়ে আসে। ঘৃণার কালো পাঁকের গভীরে জন্ম নেয় প্রেম। নরউড থমাস যখন প্রথমবার দেখেছিলেন জয়েস মরিসকে, চোখ ফেরাতে পারেননি। সময়টা কিন্তু যুবতীর কটাক্ষে বুকচেরা রিনরিনে অনুভূতি নিয়ে ঘোরার মতো মোটেই নয়। তখনও পুরোদমে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
[ আরও পড়ুন: Russia-Ukraine War: মোদি সরকারের ভ্রান্ত নীতির জেরেই এক মেরুতে পাকিস্তান-রাশিয়া-চিন! বিস্ফোরক রাহুল]
১৯৪৪ সালে মার্কিন সেনাকর্মী নরউড থমাস ছিলেন লন্ডনে। টেমসের তীরে বেড়াতে এসেছিলেন জয়েস। তিনি তখন নার্সিংয়ের ছাত্রী। শুরু হয় দু’জনের চিঠি দেওয়া নেওয়া। কিন্তু যুদ্ধের শেষে থমাস বাড়ি ফিরে গেলেন। অস্ট্রেলিয়া চলে গেলেন তাঁর প্রেমিকা। আর কোনও যোগাযোগ থাকেনি দু’জনের। আসলে জয়েসের ধারণা হয়েছিল থমাস নতুন কোনও সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এরপর দু’জনের আলাদা বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু জয়েসের সম্পর্ক টেকেনি। ২০০১ সালে মারা যান থমাসের স্ত্রীও। ৭০ বছর পরে স্কাইপে কথা হয় নিঃসঙ্গ দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার। পরে দেখাও হয় তাঁদের। আবার কাছাকাছি আসে দু’টি মন। কিন্তু থেকে যায় আফশোস। জীবন গিয়েছে চলে…
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বললে নাৎসিদের ইহুদি নিধনের প্রসঙ্গ আসবেই। ঘৃণা ও হত্যার এমন নির্লজ্জ উৎসব পৃথিবী আর দেখেনি। অথচ ভাবা যায়, এক নাৎসি অফিসারই কিনা প্রেমে পড়েছিলেন এক ইহুদি তরুণীর! ক্যাপ্টেন উইলি সুলৎজ দেখতে পেয়েছিলেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মৃত্যুমিছিল ও নির্যাতনের দমবন্ধ অন্ধকারেও স্টেইন নামের সেই তরুণীর ঠোঁটে লেগে আছে হাসির ছোঁয়া। দু’চোখে জীবনের প্রতি বিস্ময়ঘন কাজল। সুলৎজ এমনিতেও ব্যক্তিগত ভাবে ইহুদিদের কাপুরুষের মতো নৃশংস ভাবে হত্যা করাটা পছন্দ করতেন না। স্টেইনকে দেখার পর তাঁর মন আরও বদলে যায়। শেষ পর্যন্ত সুলৎজ নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জার্মান অধিকৃত এলাকা থেকে মুক্তির প্রান্তরে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন প্রেমিকাকে। দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন স্টেইন। কিন্তু ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরেই মেনিনজাইটিসে ভুগে মৃত্যু হয় সুলৎজের। কার্যত এক অনুচ্চারিত প্রেম হয়েই থেকে যায় এই ঘটনা। ইতিহাসের পাতায় রয়ে গিয়েছে আগুনঝরা দিনের আশ্চর্য এই প্রেমের আখ্যান। ‘স্তালিনগ্রাদ’-এর মতো ছবি কিংবা ‘নো উওম্যানস ল্যান্ড’-এর (২০১৫) মতো উপন্যাসে বারবার যা ফিরে ফিরে এসেছে।
[আরও পড়ুন: কৌতুকাভিনেতা থেকে রাষ্ট্রনেতা, এবার সাম্রাজ্য হারানোর পথে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি?]
কিন্তু যুদ্ধের সময় প্রেম মানে কি কেবলই সমুদ্রের বুকে জেগে থাকা লাইটহাউসের মতো বিচ্ছেদের অবধারিত উপস্থিতি? তা নয় অবশ্যই। এবার তেমনই এক মিলনান্তক গল্প বলা যাক। ১৮৬১ সালের ২০ এপ্রিল বিয়ে হয় আরাবেলা বার্লো ও ফ্র্যাঙ্কের। পেশায় আইনজীবী হওয়ার পাশাপাশি ফ্র্যাঙ্ক মার্কিন ‘ইউনিয়ন আর্মি’র সেনাকর্মীও ছিলেন। বিয়ের দিনই যুদ্ধে যাওয়ার ডাক পেলেন তিনি। সিভিল ওয়ার। ব্যাস! বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে ঘুরে কেটে যেতে লাগল জীবন। এদিকে পেশায় নার্স আরাবেলার দায়িত্ব পড়ল যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সেনার শুশ্রূষার। দু’জনের দেখা অবশ্য হত মাঝেমধ্যে। এর মধ্যেই ‘ব্যাটল অফ গেটিসবার্গ’-এ ফ্র্যাঙ্ক গুরুতর চোট পেলেন। পিঠ, ঘাড় এফোঁড় ওফোঁড় গুলিতে। তাঁর মনে হল শেষ সময় উপস্থিত। জলতেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। জানতেন তাঁর স্ত্রী কাছাকাছিই আছেন। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে একবার আরাবেলাকে দেখতে চাইলেন ফ্র্যাঙ্ক। প্রিয় মানুষটির কোলে মাথা রেখেই পাড়ি দিতে চাইলেন না ফেরার দেশে। কিন্তু আরাবেলা অত সহজে হাল ছেড়ে দিতে চাননি। তাঁর সেবাতেই জীবনে ফিরলেন ফ্র্যাঙ্ক। ডাক্তাররাও অবাক। তরুণ ওই সেনা সম্পর্কে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। অবশেষে তাঁদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল বিষয়টা। ভালবাসাই তাহলে সেই অমোঘ অমৃত, যা মৃত্যুর ঠান্ডা নিঃশ্বাসকেও হার মানাতে পারে।
যুদ্ধ হোক, তা কেবল আগ্রাসী রাষ্ট্রনায়করাই চান। বাকি পৃথিবী জানে যুদ্ধ কেবল ধ্বংস আর মৃত্যুর মিছিল ছাড়া কিছু চায় না। আর যাঁরা প্রেমে পড়েন? তখন তো প্রেমিক বলে ওঠেন, ”তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা, ভয় নেই এমন দিন এনে দেব , দেখো সেনাবাহিনী বন্দুক নয়, শুধু গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ করবে তোমার সামনে।” কিন্তু সে সব তো স্বপ্ন। যুদ্ধের পাথুরে আঘাত এক নিমেষে সব বদলে দেয়। শুধু তো প্রেম নয়, সব সম্পর্ক, মানুষে মানুষে বিশ্বাসের সমীকরণগুলোকেই যেন চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকে। মনে পড়ে ‘সানফ্লাওয়ার’ (১৯৭০) ছবিটার কথা। সোফিয়া লোরেন ও মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ান্নির সেই ছবিতে ভালবাসার সঙ্গীকে ছেড়ে যেতে নাছোড় অ্যান্তনিও উন্মাদ হয়ে যাওয়ার ভান করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের অনিবার্য নিয়তিকে সে এড়াতে পারেনি। চিরকালের মতোই বদলে গিয়েছিল জীবন।
রুপোলি পর্দার সেই জীবন কেবল বানানো গল্প নয়। বাস্তবের পৃথিবী থেকে তুলে আনা বিচ্ছেদগাথারই প্রতিফলন যেন। একথা স্বীকার করতেই হবে, যুদ্ধ শয়তানের মতোই অমর। সে ফিরে ফিরে আসে। অন্যদিকে ঈশ্বরের মতোই ভালবাসাও সব সময়ই মিশে থাকে বাতাসে। ফলে যতই বিষিয়ে যাক চরাচর, ভালবাসা পথ দেখায়। জিইয়ে রাখে বিশ্বাস। হাতের মুঠোয় তুলে দিতে থাকে আশ্বাস। যে আশ্বাসকে সামনে রেখে যুদ্ধের বিষণ্ণ মরুপ্রান্তর পার হয়ে যাওয়া যায়।