কৃশানু মজুমদার: এই শহর তাঁর। তাঁর নামে এখনও জয়ধ্বনি ওঠে বাঙালির বড় প্রাণের, বড় আপন ইডেন গার্ডেন্সে। শহরের আনাচকানাচের অলিখিত সম্রাট তিনিই। তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)। প্রিন্স অফ ক্যালক্যাটা। শহরের শ্বাসপ্রশ্বাসে শুধুই সৌরভ আর সৌরভ।
আজ থেকে ১৬ বছর আগে কলকাতা নাইট রাইডার্স-এর ব্র্যান্ড ভ্যালু তিনি এবং এসআরকে ম্যাজিকে সেই যে ঊর্ধ্বমুখী হল, দিন যত এগিয়েছে, বছর যত গড়িয়েছে, ততই কেকেআরের সেনসেক্স এভারেস্ট ছুঁয়েছে। কিন্তু বেহালার ছেলেটার সৌরভ কি মুছে গিয়েছে নাইটদের সাজঘর থেকে? এই
ফ্র্যাঞ্চাইজি যতদিন, ততদিন সাজঘরে ম ম করবেন মহারাজ। কলকাতা নাইট রাইডার্স আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পর্ক যেন মান্না দের সেই বিখ্যাত গানের লাইন, ''হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে।''
[আরও পড়ুন: আজ ইস্টবেঙ্গলের সামনে কেরালা, কুয়াদ্রাত না থাকলেও ৩ পয়েন্টের আশায় বিনো]
আজ দক্ষিণের শহর বিশাখাপত্তনমে প্রিয় শহরের হারই চাইবেন মহারাজ। তাঁর সঙ্গে কথা না বলেও চোখ বন্ধ করে তা বলে দেওয়াই যায়। আইপিএলে (IPL) আজ যে সেই আবেগের লড়াই। লড়াই নস্টালজিয়ারও। বহিরঙ্গে কলকাতা বনাম দিল্লি। আসলে তো সৌরভ আর গম্ভীরের (Gautam Gambhir) মগজাস্ত্রের লড়াই। সৌরভের অভিজ্ঞান যদি হন ঋষভ পন্থ-ডেভিড ওয়ার্নার, তাহলে গম্ভীরের হাতে রয়েছে একাধিক তুরুপের তাস। আজকের ক্রিকেট দ্বৈরথের আগে ক্রিকেটভক্তরা নস্টালজিক হয়ে পড়ছেন। সরে যাচ্ছে অতীতের পর্দা। ভেসে উঠছে সেই সব ফেলে আসা দিন।
কেকেআরে বেহালার ছেলেটার জমানা দেখেছে এদেশ। আবার গৌতম গম্ভীর যুগও দেখেছে কলকাতা। কেকেআরে সৌরভ আর গম্ভীর অধ্যায় নিয়ে কিছু বলতে গেলে সেই বিখ্যাত ইংরেজি কবিতার লাইন মনে পড়ে যেতে বাধ্য- 'ইফ উইন্টার কামস ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড'। কলকাতার সিংহাসন ছেড়ে মহারাজের সরে যাওয়া যে গম্ভীরের রাজ্যাভিষেকের পথই প্রশস্ত করে। সৌরভের ছেড়ে যাওয়া সিংহাসনে অভিষেক ঘটে গম্ভীরের।
বিশ্বজয়ীর মুকুট পরে গম্ভীর এই শহরে এসেছিলেন ক্রিকেটের ভাগ্যান্বেষণে। এই শহর তাঁকে খালি হাতে ফেরায়নি। যে শহর নিজের সৌরভের কীর্তির শরিক হতে পারেনি, সেই শহর হৃদয় উপুড় করে দিয়েছে সেই গৌতম গম্ভীরকে। নাইট অধিনায়ক হিসেবে গম্ভীর দুবার আইপিএল চ্যাম্পিয়ন করেছেন কলকাতাকে। দিল্লি ছেড়ে কলকাতা হয়ে গিয়েছে গম্ভীরের হৃদয়ের রাজধানী।
ক্রিকেটার গম্ভীরের সময় সেই কবেই ফুরিয়েছে। মেন্টর গম্ভীর লখনউ হয়ে আবারও ফিরেছেন তাঁর পুরনো শহরে। তাঁর ছোঁয়ায় কল্লোলিনী আবার তিলোত্তমা হয়েছে। এবারের আইপিএলে মেঘের উপর দিয়ে হাঁটছে কলকাতা। প্রথম দুম্যাচেই জয়। মরশুম শুরুর আগে শাহরুখকে স্মরণ করে গম্ভীরকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ''এসআরকে আমাকে বলেছিলেন, এই ফ্র্যাঞ্চাইজি তোমার, ভাঙা-গড়া তোমারই হাতে।'' গম্ভীর গড়ছেন তাঁর কেকেআরকে। শহরের বাতাসে গানের সুর ভাসছে, করব, লড়ব, জিতব রে।
অন্যদিকে তিন ম্যাচের প্রথম দুটি ম্যাচই হেরেছে দিল্লি। কিন্তু কলকাতার বিরুদ্ধে নামার আগে ধোনির চেন্নাইকে হারিয়েছে পন্থের দিল্লি। রাজধানীর ফ্র্যাঞ্চাইজি পরশপাথরের ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে। চেন্নাই ম্যাচের পর পন্থকে তাতিয়েছেন সৌরভ। বলেছেন, ''এই ইনিংসটা তোমার সঙ্গে সারা জীবন থেকে যাবে।''
ক্রিকেটপাগলরা টাইমমেশিনের সাহায্য না নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন সেই গম্ভীর জমানায়। একদিন নীরবে নিভৃতে সৌরভকে সরে যেতে হয়েছিল নাইট শিবির থেকে। মহারাজের নিষ্ক্রমণ নিয়ে নিন্দুকরা অবশ্য অন্য কথা বলে থাকেন। এই পরিসরে সেই বিতর্কিত অধ্যায় নিয়ে নাইবা কালি খরচ করা হল। সৌরভের চলে যাওয়ার পরে ঘরের মাঠ ইডেন বোধহয় হয়ে উঠেছিল নাইটদের কাছে বধ্যভূমি। ইডেনে দেখা যেত 'নো সৌরভ, নো ক্রিকেট' লেখা প্ল্যাকার্ড। মনের মানুষকে কি ভুলতে পেরেছিল শহর কলকাতা?
পুণের জার্সিতে ইডেনে সৌরভ। প্রতিপক্ষ কলকাতা। বাংলা ভাগ হয়েছিল সেদিন। ঘরের ছেলের জন্য গলা ফাটিয়েছিল ইডেন। ঠিক যেমন গুরু গ্রেগের টিম ইন্ডিয়া এই ইডেনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলতে নেমে তীব্র বিরুদ্ধস্রোতের মুখোমুখি হয়েছিল। তদানীন্তন অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়কে বলতে শোনা গিয়েছিল, ''মনে হচ্ছিল দেশের বাইরে খেলছি।'' সৌরভের বঞ্চনা কীভাবে মেনে নেয় কলকাতা। এই শহর জানে তাঁর প্রথম সবকিছু। সৌরভের জন্য এই হৃদয়ের দপ্তর আজও বদলায়নি কলকাতা।
ঘরের ছেলে মহারাজ বন্দর বদলে ফেলেছেন গত কয়েক বছর ধরেই। তিনি এখন দিল্লি ক্যাপিটালস-এর অধীশ্বর। প্রথমে স্রেফ মেন্টর। এখন মেন্টর কাম ক্রিকেট ডিরেক্টর! রিকি পন্টিং সামনে থাকলেও আসল চাণক্য ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক।
কলকাতা আজ কার দিকে ঝুঁকে? আবেগের বিস্ফোরণের এই ম্যাচে কলকাতা কি কোনও একটি পক্ষকে সমর্থন করতে পারে!