ডা. শাশ্বতী হালদার: কথায় আছে ‘স্কিন কেয়ার ইজ হেলথ কেয়ার’। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, ত্বকই একজনের স্বাস্থ্যের আয়না। অর্থাৎ, শরীরের ভিতরটা কেমন আছে, তা বোঝা যায় ত্বক দেখে। তাছাড়া, ত্বকই শরীরের বৃহত্তম অঙ্গ। তাই, মোটেই হেলাফেলার বস্তু নয় ত্বক। ত্বকের পরিচর্যা মানে শুধু ক্রিম বা লোশন মাখা নয় বরং অনেক বেশি জরুরি সঠিক ও স্বাস্থ্যকর ডায়েট মেনে চলা। শুধু শরীর নয়, ত্বকের জেল্লার জন্যও পুষ্টিকর ডায়েট গুরুত্বপূর্ণ।
ত্বকের লাবণ্য আনবে কোন ডায়েট?
দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় প্রোটিন-ভিটামিন-মিনারেলের যথাযথ সমতা বজায় রাখতে পারলে লাবণ্যে ভরা ত্বক পেতে পারেন যে কেউ। সঙ্গে বাদ দিতে হবে বেশ কিছু বদ খাদ্যাভ্যাস। ত্বকের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন ডায়েটে এ, ডি, ই, কে, বি কমপ্লেক্স জাতীয় ভিটামিন রাখা জরুরি। শরীরে এই ভিটামিনের ঘাটতি হলে ত্বকে শুষ্কতা-সহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এদের মধ্যে ভিটামিন ই এবং জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, সেলেনিয়ামের মতো মিনারেল ত্বকের ‘গ্লো’ বা জেল্লা বজায় রাখতে সাহায্য করে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন জল কম খাওয়া, অতিরিক্ত মদ্যপান, ধূমপান বা অত্যধিক তেল-চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া– শরীরে ফ্রি র্যাডিকেলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করে। তাই আমাদের প্রয়োজন সুষম খাদ্য গ্রহণ করা।
বাদ দিলে ভাল
আলু,পাঁউরুটি, প্রসেসড ময়দা, চিনি ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্যে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি। এগুলি রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ‘গ্লাইকেশন’-এর ফলে চামড়া আরও শক্ত এবং শুষ্ক হয়ে যায়। জেল্লা কমে আসে। এছাড়া নিয়মিত মদ্যপান করলে ত্বক আর্দ্রতা হারায়, চামড়ায় বয়সের ছাপ তাড়াতাড়ি পড়ে। আবার অতিরিক্ত ধূমপান করলেও ত্বকে ফ্রি র্যাডিক্যাল বেশি তৈরি হয়, যার ফলে ত্বকের ডিএনএ নষ্ট হতে পারে। সোরিয়াসিস-সহ বিভিন্ন ‘অটো-ইমিউন’ স্কিন ডিজিজ হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। দুগ্ধজাত খাবার যেমন- মাখন, চিজ, মিষ্টি বেশি পরিমাণে খেলে ‘ইনসুলিন লাইক গ্রোথ ফ্যাকটর’ নামে এক ধরনের পদার্থ বেড়ে যায়। ফলে অ্যানড্রোজেন দ্বারা ত্বকের সিবাম ক্ষরণ বাড়ে, ব্রণও বাড়ে।
[আরও পড়ুন: দাঁতের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে কোন উপায়ে? টিপস দিলেন বিশেষজ্ঞ]
গ্রিন টি, টক দইয়ে ঝকঝকে
সবার আগে দরকার, বিভিন্ন খাবারের মধ্যে সমতা বজায় রাখা। ভিটামিন এ, সি, ই ত্বককে টানটান রাখা ছাড়াও শরীরের ভিতর থেকে সানস্ক্রিনেরও কাজ করে। অর্থাৎ এরা হল ‘সিস্টেমিক সানস্ক্রিন’। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের কিছু উদাহরণ হল যে কোনও লেবু (কমলা, মুসাম্বি, পাতিলেবু), আমলকী, পেয়ারা, লঙ্কা। ভিটামিন ইয়ের জন্য খান গাজর, আম, টমেটো।
আর প্রয়োজন প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার যেমন টকদই। এতে এমন কিছু ব্যাকটিরিয়া আছে, যার অস্তিত্ব রয়েছে আমাদের ত্বকে। ত্বককে সুস্থ রাখা, ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়াগুলিকে বাড়তে না দেওয়া এদের প্রধান কাজ।
এছাড়া, গ্রিন টি খান। এতে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট থাকে। পাশাপাশি ফ্ল্যাভনয়েড থাকে, যা ত্বকের ডিএনএর ক্ষতি আটকায়। ব্রণ রুখতেও সাহায্য করে।
মনে রাখবেন, ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা বজায় রাখতে দিনে তিন থেকে চার লিটার জল পান করতেই হবে। এছাড়াও শসা, তরমুজ, লেটুসজাতীয় খাবারও খেতে পারেন। এতে জলের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবে বেশি থাকে।
ফ্যাট থেকে দূরে
সামগ্রিকভাবে খাদ্যতালিকা বাছাইয়ে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। তবে কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। যেমন যে সব মহিলার পিসিওএস আছে, তাদের তেল বা চর্বিজাতীয় খাবার কম খাওয়া উচিত। বিশেষত স্যাচুরেটেড ফ্যাট নিয়ে সাবধানতা জরুরি। খাসির মাংসের পরিবর্তে বেছে নিন শাকসবজি, ফলমূল এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডে ভরপুর মাছ।
মেনোপজ কালে মহিলাদের ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার যেমন দুধ, ছোলা, ডাল বেশি করে খেতে হবে। এছাড়াও পালং শাক, মাছ, ডিমের মতো আয়রন জাতীয় খাবারও প্রয়োজন। এই সময় মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে যায়। কিছু কিছু উদ্ভিজ্জ খাবারে ফাইটো-ইস্ট্রোজেন থাকে। যেমন সয়াবিন, ছোলা, বাদাম, বার্লি।
বয়সের সতর্কতা
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ত্বক ঠিক রাখতে খাদ্যাভ্যাসের বদল করা জরুরি। কমাতে হবে খাওয়ার পরিমাণও। তাছাড়া বয়সকালে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিসের মতো নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। বর্তমান জীবনযাত্রায় অনেকের ক্ষেত্রেই এই রোগের উপসর্গ আগেই দেখা যায়। তাই খাদ্যতালিকায়, খাদ্যাভ্যাসে কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। খুব বেশি কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য যেমন আলু, ভাত ইত্যাদি কম খান। শরীরে প্রোটিনের মাত্রা বজায় রাখতে ডিম, চিকেন, মাছ, ডাল, খিচুড়ি, সয়াবিন খান। আয়রন, ক্যালশিয়ামের জন্য টক দই, মাছ, শাক-সবজি, আমন্ড বাদাম খান। প্রয়োজনে ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শে বাইরে থেকে সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন। প্রেগন্যান্সির সময় বেশি করে ফলমূল, শাকসবজি খান।
অধ্যাপক ডা. শাশ্বতী হালদার
স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের চর্মরোগ বিভাগের প্রধান।