shono
Advertisement

‘সুনীল সেই হীরে, যার বিকল্প হয় না’, একান্ত সাক্ষাৎকারে ভারতীয় কোচ স্টিমাচ

একবার ভারতীয় দলের চাকরিও হারাতে বসেছিলেন, জানালেন কোচ।
Posted: 10:29 AM Jun 23, 2023Updated: 10:30 AM Jun 23, 2023

দুলাল দে: সাফল্যের চূড়োয় আছেন। একটাও গোল না খেয়ে ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপে (Inter Continental Cup) চ্যাম্পিয়ন। সাফেও প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তানকে ৪ গোল! কিন্তু জানেন, সামান্য একটা ভুলে ফের শুরু হয়ে যেতে পারে দেশজুড়ে সমালোচনা। সবই জানেন তিনি। ঠিক করলেন পাকিস্তান ম্যাচের পরের দিনই লাঞ্চ টাইমে টিম হোটেলে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সঙ্গে মন খুলে আড্ডা দেবেন ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ (Igor Štimac)। যাকে সাক্ষাৎকার না বলে আড্ডা বলাই ভাল। কারণ, উত্তর দেওয়ার বদলে স্টিমাচ যে নিজেই প্রথম প্রশ্নটা করে বসলেন!

Advertisement

ইগর: নিশ্চয়ই শুরুতে সেই এক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন?
প্রশ্ন: কোনটা বলুন তো?
ইগর: চার-সাড়ে চার বছর আগে ভারতের কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন থেকে যে প্রশ্ন অনবরত শুনে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: ঠিক বুঝলাম না।
ইগর: কেন? একটাই তো প্রশ্ন। আমার দলে সুনীল ছেত্রীর বিকল্প কে? (হাসি)
প্রশ্ন: সে তো হবেই।
ইগর: ধরুন, আপনার কাছে অতি দুর্লভ একটি হীরে আছে। আপনি কি বিকল্প হীরে খুঁজবেন? না কি, সেই হীরেকেই রোজ যত্ন করে আরও ঝকঝকে করে তুলবেন?
প্রশ্ন: অবশ্যই ঝকঝকে করে তুলব।
ইগর: ইয়েস। এটাই বোঝাতে চাইছি। সুনীল সেই দুর্লভ হীরে। তাহলে ওর বিকল্প খুঁজতে যাব কেন? ওর যত্ন নিয়ে বরং ওকে আরও শক্তিশালী, আরও নিখুঁত করে তুলব। পারফরম্যান্সের গ্রাফ দেখলেই বুঝতে পারবেন। শেষ কয়েকবছর ধরে জাতীয় দলে সুনীলের (Sunil Chhetri) সেরা সময়টা চলছে।

প্রশ্ন: প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে চার গোল। রাতের ঘুমটা দারুণ হল নাকি মুহূর্তের ভুলে রেড কার্ড দেখে বিরক্তিতে ঘুমটাই চলে গেল?
ইগর: পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারতীয়দের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি, এটাই আনন্দের। ঘুমোতে দেরি হয়েছে অন্য কারণে।
প্রশ্ন: লাল কার্ডের জন্য?
ইগর: দলকে বাঁচানোর জন্য যদি রেড কার্ড দেখতে হয়, তাহলে হাজারবার দেখব। তখন দু’গোলে এগিয়ে। প্রথমার্ধের অতিরিক্ত সময় চলছে। আমার সামনে পাকিস্তানের এক ডিফেন্ডার প্রীতমকে (Pritam Kotal) ফাউল করল। অথচ রেফারি চুপ। আমার ডিফেন্স অসতর্ক। পাকিস্তান দ্রুত থ্রো করে কাউন্টার অ্যাটাকে যাচ্ছিল দেখে বলটা ওদের ফুটবলারের হাত থেকে সরিয়ে দিই। জানতাম, পরিষ্কার রেড কার্ড। কিন্তু মাথায় ছিল, দলকে আগে রক্ষা করতে হবে।
প্রশ্ন: কোচ ছাড়া নেপাল ম্যাচ খেলতে অসুবিধা হবে না?
ইগর: টানা প্রসেসের মধ্য দিয়ে আমার দল তৈরি। উলটো দিকের গ্যালারিতে বসে আরাম করে ম্যাচটা দেখব। আমি ডাগআউটে না থাকলেও সেই পরিকল্পনায় কোনও প্রবলেম হবে না।
প্রশ্ন: ইন্টার কন্টিনেন্টালে (Inter Continental Cup) চারটে ম্যাচ সঙ্গে সাফের পাকিস্তান ধরলে, সন্দেশ ছাড়া বারবার দল বদলেছে।

[আরও পড়ুন: ‘রাজ্যের বিড়ম্বনা বাড়ানোর চেষ্টা’, নিবার্চন কমিশনার নিয়োগে জটিলতা নিয়ে রাজ্যপালকে তোপ সৌগতর]

ইগর: অনেকে বুঝতে না পেরে সমালোচনা করে বলছেন, আমি নাকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। আসলে এটা একটা প্রসেস। এর ভাল দিকটা কেউ বুঝছে না। ২৩ জন ফুটবলারকে ঘুরিয়েফিরিয়ে খেলিয়েও টানা পাঁচটা ম্যাচে আমরা একটাও গোল খাইনি। এই মুহূর্তে টিম হোটেলে থাকা ২৩ জন নয়। মোট ৪৫ জন ফুটবলার আমার তৈরি আছে। যে কেউ যখন খুশি খেললেও কোনও সমস্যা হবে না। পুরো স্কোয়াডটা একদিনে তৈরি হয়নি। ইটস আ লং প্রসেস। কিন্তু এখানে সবাই একদিনে সাফল্য চায়। সমর্থকদের চাহিদা আদতে পর্বতের চূড়ো। আর বাস্তব একদম বেস ক্যাম্প। চার বছর আগে যখন দলটার দায়িত্ব নিয়ে বুঝলাম, বেসিকস শেখাতে হবে। আক্রমণে গেলে, টিমের শেপ কীরকম হবে? ডিফেন্স করার সময় কী রকম? মিডফিল্ডার কীভাবে ব্যালান্স করবে? উন্নত ফুটবল দেশে এই বেসিকসগুলো অ্যাকাডেমিতে শেখানো হয়। আমাকে জাতীয় শিবিরে (National Camp) ধীরে ধীরে শেখাতে হয়েছে। তার সাফল্য এখন পাচ্ছি। অথচ আর একটু হলে এতদিনে আমার ছুটি হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল!


প্রশ্ন: কীরকম?
ইগর: ২০২১-তে মালদ্বীপের সাফে (SAAF) যাওয়ার আগে জেনে যাই, চ্যাম্পিয়ন না হলে আমার কোচের চাকরিটা যাবে। করোনা আবহে মালদ্বীপ যাওয়ার চারদিন আগে দল পেলাম। এ তো মেসি-রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo) নয়, যে মুহূর্তে ফুটবলারদের পাব, জাস্ট সুইচ অন করে দিলেই সবাই ফর্মেশনে চলে আসবে। ক্লাব ফুটবলে সবাই আলাদা আলাদা ঘরানার কোচের কাছে থাকে। জাতীয় দলে (Indian Team) এসে ফের আমার পরিকল্পনায় অ্যাডজাস্ট করতে হয়। সময় তো লাগবেই। সেই জায়গা থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চাকরি বাঁচিয়েছি। আমি বলব, শুরুতে রেজাল্ট নয়। প্রসেসটা দেখুন। লং টার্ম প্রসেসটা দেখুন। ভারতের মতো দেশে একদিনে ফুটবলকে ঘোরানো যাবে না। কম করে পঁচিশ বছর ধরে টানা একই পরিকল্পনায় চলতে হবে। চারটে বছর পেতেই দেখুন, দলটার খেলা এখন কত ভাল লাগছে।

[আরও পড়ুন: রাজ্যপাল-নির্বাচন কমিশন দ্বন্দ্ব, রাজীব সিনহার পাশে দাঁড়িয়ে ‘লড়ে নেওয়া’র বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর]

প্রশ্ন: আচ্ছা এই দলের ফুটবলারদের কাছে আপনি বাবা না বড় দাদার মতো?
ইগর: বন্ধুর মতো। কিন্তু কারও প্রিয় বন্ধু হতে চাই না। মাত্র পাঁচ ঘণ্টা ঘুমোই আমি। ফুটবলাররা জানে, রাত তিনটের সময়েও আমার ঘরের দরজা বন্ধ থাকে না। সমস্যা হলে সেই সময়েও ‘নক’ করে যে কেউ আমার ঘরে চলে আসতে পারে। ফুটবলারদের সঙ্গে সম্পর্কটা বিশ্বাসের।
প্রশ্ন: আচ্ছা, সুনীলদের কখনও বকাঝকা করেন?
ইগর: সুনীল, সন্দেশ হচ্ছে জন্মগত লিডার। ওদের কিছু বলতেই হয় না। শুধু প্রতি ম্যাচের আগে সুনীলের একবার মতামত নিই, বিশ্রাম চায় না খেলতে চায়? খেলার জন্য এত খিদে যে সুনীল সব সময় রেডি। ফুটবলারদের উপর যা কিছু চোটপাট মাঠেই করি। কাউকে অন্যায় করতে দেখলে একটা লেভেল পর্যন্ত ধৈর্য ধরি। তার উপরে গেলে সমস্যা আছে।
প্রশ্ন: ফুটবলাররা আপনাকে না বলে টিম হোটেলের বাইরে যেতে পারে? স্বাধীনতা দেন?
ইগর: কোথাও যাওয়ার সময় কোথায়? সকালে মনঃসংযোগ ক্লাস। তার পর ব্রেকফাস্ট। টিম মিটিং। লাঞ্চের পর দু’ঘণ্টা বিশ্রাম। তারপর প্র্যাকটিসে। এরপরেও কেউ বাইরে যেতে চাইলে আমার পারমিশন নিয়ে যেতেই পারে।
প্রশ্ন: শুরুতেই আপনি সমালোচনার কথা বলছিলেন। একটা অভিযোগ অবশ্য আছে। আপনি সারা বছর ঘুরে ঘুরে ম্যাচ দেখেন না। দেশে থাকেন?
ইগর: এর উত্তর আমিও দিতে চাইছিলাম। আমার পাঁচ সন্তান। সঙ্গে আমার স্ত্রী। এই সাতজনের বিমান ভাড়া, খাওয়া, ভারতে থাকতে গেলে যা খরচ হবে, তাতে আমার সঙ্গে ফেডারেশনের যে আর্থিক চুক্তি তার থেকে বেশি হয়ে যাবে। বাড়িতে বসে ল্যাপটপে প্রতিটা ম্যাচ দেখি। সেই মতো ক্লাব কোচদের সঙ্গে কথা বলে সংশ্লিষ্ট ফুটবলারের রিপোর্ট নিই। জাতীয় দলের সব ফুটবলারের সঙ্গে সারা বছর ধরে টাচে থাকি। পরামর্শ দিই। লোক দেখানোর জন্য ফেডারেশনের টাকায় ম্যাচ দেখতে ঘুরে বেড়াতে চাই না। বিমান ভাড়া, দামি হোটেলের খরচ। আর স্টেডিয়ামে গেলে এতজনের সঙ্গে হাত মেলানো, মিডিয়ার চাপে ম্যাচটাই ঠিকভাবে দেখা যায় না। কিন্তু তাতে সবাই দেখত যে, আমি ঘুরে ঘুরে ম্যাচ দেখছি। অথচ ঘরে বসে এর থেকে অনেক ঠান্ডা মাথায় প্রতিটা ম্যাচ দেখে বিশ্লেষণ করতে পারি। ম্যাচ দেখার জন্য ফেডারেশনের আমার পিছনে যা খরচ হত, সেটা অন্য কাজে করা যেতে পারে।
প্রশ্ন: এশিয়ান কাপের আগে প্রস্তুতির জন্য কিংস কাপ, মারডেকা আর বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড। অন্য আর কিছু পরিকল্পনা আছে?
ইগর: এশিয়ান কাপের আগে ৬ সপ্তাহের ক্যাম্প হলে ভাল হয়। তাহলে তিনটে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলব। খুব কম করেও চার সপ্তাহর ক্যাম্প করতেই হবে। তাহলে অবশ্য কোনও ম্যাচই খেলব না। একটা ম্যাচ খেলা মানে সামনে-পিছনে চারটে দিন নষ্ট। আর একটা ম্যাচ খেলে আমার পরিকল্পনা অন্যদের দেখাতে চাই না। যদিও আমি জানি না, ডিসেম্বরে চার সপ্তাহর ক্যাম্প করার সুযোগ পাব কি না? আমি শুধু পরিকল্পনা জানাতে পারি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার হাতে নেই। আচ্ছা, এবার কিন্তু আড্ডা থামাতে হবে। প্র্যাকটিসে যেতে হবে। পরের ম্যাচে বেঞ্চে থাকতে পারব না। আজ প্র্যাকটিস তাই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement