বিশ্বদীপ দে: সাইকো (Psycho)। আজকাল এই শব্দটা চালু লব্জ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কাউকে অপছন্দ হলে, তার কোনও অসংলগ্ন ব্যবহারের সামান্য হদিশ পেলেই আগাপাশতলা না ভেবে ‘সাইকো’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার এই চল দেখলে স্বয়ং অ্যালফ্রেড হিচকক কী বলতেন জানা নেই। জানা সম্ভবও নয়। তবে এক গভীর মানসিক অসুখকে এভাবে গালাগালি করে তোলাটা তাঁর যে ঘোরতর নাপসন্দ হত তা হলফ করে বলাই যায়। যাই হোক, এই লেখা হিচকককে নিয়ে নয়। কিংবা তাঁর কাল্ট হয়ে যাওয়া ‘সাইকো’ (১৯৬০) ছবি নিয়েও নয়। বলা যায়, আধুনিক সভ্যতার বুকে একাকীত্বের মারণ শেল কীভাবে মানুষকে নির্লিপ্তি, নিষ্ঠুরতা ও নৈরাজ্যের অধিকারী করে তুলতে পারে তার একটি অনন্য কেস স্টাডিই এই লেখার প্রাণভোমরা।
আজ থেকে কয়েক বছর আগে রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল কাণ্ড আমাদের সকলকেই অস্বস্তির এক বিকট অন্ধকারের সামনে ফেলে দিয়েছিল। দিদির মৃতদেহের সঙ্গে পার্থ দে নামে জনৈক ব্যক্তির মাসের পর মাস কাটানোর অভিজ্ঞতা মনকে একটা বেলজারচাপা অনুভূতিতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার (Australia) ব্রুস অ্যান্ড্রু রবার্টস নামের এক ধনীর ঘটনার কাছে রবিনসন স্ট্রিটের কাণ্ডও অনেক কম ঠেকবে।
কী সেই ঘটনা? তার আগে বলা যাক রবার্টস লোকটা কেমন ছিল। সিডনির বাসিন্দা রবার্টস স্বভাবে একজন সংগ্রাহক। ‘সাপ, ব্যাঙ, শকুনের ঠ্যাং’ এসব তার সংগ্রহে ছিল কিনা জানা নেই, তবে তার বাড়ির প্রতিটা কোনায় থাকত নানা আজব জিনিস। তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব জিনিসপত্রে ঠাসা চারপাশ। বলতে গেলে কিছুই সে ফেলত না। বাক্সপ্যাঁটরা, খবরের কাগজ, বাতিল যন্ত্রপাতি- সব জমিয়ে রাখত। তাকে বাধা দেওয়ারও কেউ নেই। সে যে একেবারে একলা। কারও সঙ্গে তার বনত না। একা একা ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে বসে থাকত। বাবার রেখে যাওয়া টাকায় উপার্জনের প্রয়োজন ছিল না। ফলে দরজা-জানলা বন্ধ করে রেখে নিজের মতো করেই সে বাড়িটাকে বানিয়ে তুলেছিল কার্যত একটা দমবন্ধ আস্তাকুঁড়।
[আরও পড়ুন: প্রেমিকার সঙ্গ চাই, সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ির সামনে ডাক ছেড়ে ধরনা ছাগলের!]
২০১৭ সালে ৬০ বছর বয়সে রবার্টস মারা যায়। তাও সকলের অজ্ঞাতসারে। প্রতিবেশীদের সন্দেহ হওয়ায় তারা পুলিশে খবর দিয়েছিল। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখতে পায় হিটারের উপরে উপুড় হয়ে দগ্ধ অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ‘ভবঘুরে’ স্বভাবের প্রৌঢ়ের। রবার্টসের দেহ উদ্ধার হওয়ার পরে এক সিনিয়র কনস্টেবল পাড়ার একদম কোণে অবস্থিত বাড়িটার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘মাত্রাতিরিক্ত রকমের সংগ্রাহক লোকটা। এমন আমি জন্মে দেখিনি। আপনি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেই দেখবেন মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত ডাঁই করে রাখা বাজে জিনিসের স্তূপ।’’
কিন্তু এপর্যন্ত হলে ব্যাপারটা কেবলই এক পাগলাটে ধরনের একলা লোকের স্বেচ্ছাবাসের একগুঁয়েমির আখ্যান হয়েই থেকে যেত। কিন্তু তখনও বাকি ছিল ‘কাহানি মে টুইস্ট’ । তবে সেটা তখনই জানা যায়নি। আরও বছরখানেক পরে আসল চমক উপস্থিত হয় পুলিশের সামনে। বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরে পরিষ্কার করার সময় ওই বাড়িরই ভিতর থেকে উদ্ধার হয় আস্ত একটা মৃতদেহ! ময়না তদন্তে পরিষ্কার হয়ে যায়, ২০০২ সালে ওই লোকটির মৃত্যু হয়েছে। আর তাকে হত্যা (Murder) করেছে রবার্টস। তারপর পরবর্তী ১৫ বছর ওই মৃতদেহের সঙ্গেই বাড়িটিতে বাস করেছে সে! খবর পেয়ে প্রতিবেশীরা চমকে ওঠেন। হাড়হিম আতঙ্কে লীন হয়ে যায় তাঁদের মন।
কিন্তু কোথা থেকে এল ওই আগন্তুক? মৃত্যুর সময় ৩৯ বছর বয়স ছিল শেন স্নেলম্যানের। সে যে কোনও সাধু উদ্দেশ্য নিয়ে রবার্টসের বাড়ি ঢোকেনি তা পরিষ্কার বোঝা যায় তার রেকর্ড ঘাঁটলে। ১৫ বছর বয়সে এক ভবঘুরেকে হত্যা করেছিল স্নেলম্যান। পরবর্তী ড্রাগ পাচারকারী হিসেবে বারবার জেলে ঢোকা আর বেরনো তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ২০০২ সালে রবার্টসের হাতে খুন হওয়ার আগেও সে সদ্য ছাড়া পেয়েছে জেল থেকে। প্রায় বছরখানেকের সাজা খেটে। ফাঁকা পকেটে চুরির উদ্দেশ্যেই সম্ভবত সে ঢুকে পড়েছিল ‘ভূতুড়ে’ বাড়িটায়। কিন্তু নজর এড়ায়নি রবার্টসের। সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে খুন করে সে। তারপর তার বাড়ির অতিরিক্ত বেডরুমে কম্বলচাপা দিয়ে ফেলে রেখে দেয় লাশ। দেহটি উদ্ধার করার সময় পুলিশ চারপাশে সত্তরটিরও বেশি এয়ার ফ্রেশনারের বোতল খুঁজে পায়। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। পচা লাশের গন্ধ যেন বাইরে না যায়। এদিকে জিনিসপত্রে ঠাসা দরজা-জানলা বন্ধ ঘরের এককোণে পড়ে থাকা স্নেলম্যানের দেহ পরিণত হয়েছিল একটি মমিতে। পচাগলা সেই দেহে দৃশ্যমান ট্যাটু আর অবশিষ্ট আঙুলের ছাপ দেখেই শনাক্ত করা গিয়েছে তাকে। সেই সঙ্গে তার পরনের পোশাক তো ছিলই।
[আরও পড়ুন: বিয়ের দিন মালাবদলের সময়ই ছেলেকে জুতোপেটা বরের মায়ের, কিন্তু কেন?]
রবার্টস যে ভিতরে ভিতরে অসম্ভব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত তার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। বাড়িটি তল্লাশি করে মোট ১৯টি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। সেই সঙ্গে আরও গোলাবারুদ, বুলেট। কেমন ছিল রবার্টসের প্রথম জীবন? কোথায় লুকিয়ে ছিল আগামিদিনে এমন মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে ওঠার বীজ। আগেই বলেছি, রীতিমতো ধনী পরিবারে জন্ম। বাবা মারা যাওয়ার পরে বোনের সঙ্গে নিয়মিত অশান্তি হত। পরে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অর্থেই নিজেদের বাড়িটি কিনে নিয়ে একেবারে একা থাকাই মনস্থ করে সে।
এক প্রতিবেশীর কখায়, ‘‘বাড়িটার আশপাশে কেউ যেত না। আজেবাজে জিনিসে ঠাসা বাড়ির মালিকের মানসিক সমস্যা ছিল জানতাম। নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখত। এমনকী, জানলাও বন্ধ। ভিতরে কী হচ্ছে দেখার উপায় ছিল না। যখনই বেরোতে দেখতাম বড়সড় বাদামি কোট পরে আছে। সে বর্ষা হোক কী শীতকাল।’’ অথচ কম করে ১০ লক্ষ ডলার শেয়ারে খাটত রবার্টসের। ব্যাংকে রাখা ছিল ৬ লক্ষ টাকা। কিন্তু বাদামি কোট পরেই জীবনটা কাটিয়ে দিল সে। একদম একা একা। আর হয়ে উঠল এমন নির্লিপ্ত, নিজের হাতে মানুষ খুন করে তার সঙ্গেই সহবাস করতে যার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। এক-দু’দিনের বিষয় নয়। একেবারে ১৫ বছর। মারা না গেলে সেই সময়কাল আরও বাড়ত।
রবিনসন স্ট্রিটের পার্খ দে মাসছয়েক কাটিয়েছিলেন দিদির কঙ্কালের সঙ্গে। সেই তুলনায় ১৫ বছর আরও দীর্ঘ সময়। যদিও এই ধরনের মানসিক অবস্থানে সময়টা আর আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। ‘সাইকো’র নরম্যান বেটসের মতোই নিজেই নিজের ভিতর অন্ধ কুয়ো তৈরি করে তার মধ্যে বাস করতে থাকেন এই আক্রান্তরা। স্থান, সময় সবই গুলিয়ে যেতে থাকে। আধুনিকতা এই সব নিঃসঙ্গতাকে আরও করুণ করে তুলেছে। ব্রুস অ্যান্ড্রু রবার্টস কিংবা পার্থ দে-র মতো মানুষদের একা হওয়ার আখ্যানে সভ্যতার দায়ও বড় কম নয়।