অরিঞ্জয় বোস: সদ্য শেষ হয়েছে শারদীয়ার মরশুম। বিসর্জন পর্ব সাঙ্গ করে বিজয়ার রীতিনীতি এখনও চলছে। ভোরের শিশিরে এখনও উমা বিদায়ের বিষণ্ণতা দেখতে পান কেউ কেউ। হেমন্তের শিরশিরে হাওয়ায় এখনও মনখারাপের আমেজ। আলোর উৎসব সেসব মুছে দিয়েছিল অবশ্য। ফের নতুন উদযাপনে মেতে উঠেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সেই আলোও যেন আচমকা নিভে গেল শহরে। বৃহস্পতিবার রাতে, আতসবাজির ফোয়ারার মাঝেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন রাজ্যের বর্ষীয়ান, জনপ্রিয় রাজনীতিক সুব্রত মুখোপাধ্যায় (Subrata Mukhrjee)। রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে যাঁর আরেকটা বড় পরিচয় ছিল পুজো উদ্যোক্তা হিসেবে। দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত একডালিয়া এভারগ্রিন (Ekdalia Evergreen) ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। যাঁর হাত ধরেই এতগুলো বছর ধরে থিমের পুজোর ভিড়ে হারিয়ে যায়নি কলকাতার সাবেকী পুজো। সনাতনী দুর্গোৎসব (Durga Puja)।
থিম বনাম সাবেকিয়ানা। কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে – দুর্গাপুজোর মরশুমে এই বিতর্ক বহুবার হয়েছে। আর যতবারই এই প্রশ্ন সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাছে উত্থাপন করেছেন কেউ, তাঁরা সকলে একটাই উত্তর পেয়েছেন। সুব্রতবাবু বলতেন, ”ওরা উৎসব করে, আমরা করি মায়ের পুজো।” একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাবের দুর্গাপুজো বরাবরই সাবেকিয়ানায় মোড়া। পাশের সিংহী পাার্কের পুজোয় কমবেশি থিমের ছোঁয়া। কিন্তু থিমের বিন্দুমাত্র আঁচও পড়তে দেননি একডালিয়ার ক্লাব প্রেসিডেন্ট সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বালিগঞ্জের এই পুজোর মণ্ডপ থেকে প্রতিমা, সাজসজ্জা – সবেতেই সনাতনী ছাপ। এখানের দেবীমূ্র্তির মধ্যে ঠিক আমাদের পরিচিত, চেনা ‘মা’য়ের মুখের আদল প্রতিফলিত হয়।
[আরও পড়ুন: আঁধার জীবনে আলোর ঠিকানা, দীপাবলির দিনে ২২ জনের চোখে ফিরল দৃষ্টি]
১৯৭১ সাল থেকে একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। দুর্গাপুজোর যাবতীয় দায়দায়িত্ব সামলাতেন নিজেই। তিনি বলতেন, ”আমরা সনাতনী পুজো করি। আমাদের সাবেকী প্রতিমা। যাঁরা ‘থিমের পুজো’ করেন, সেটা পুজো নয়। ওটা উৎসব। আমাদেরটা হল দুর্গাপুজো। এটাই পার্থক্য। কর্পোরেট হাউসগুলো যেমন যেমন চায়, তারা তেমন পুজো করে। মা দুর্গাকে নিয়ে পুজো না করে যা ইচ্ছে তাই করা যায় না। মা যেমন আশীর্বাদ করেন, তেমনই ছেলেখেলা করলে রেগেও যান।”
[আরও পড়ুন: ‘সুব্রতদার মৃত্যু আমার জীবনের বড় দুর্যোগ’, প্রিয় সহযোদ্ধাকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় মমতা]
বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর প্রয়াণের খবর পেয়ে খানিকটা আপনমনেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) বলছিলেন, ”সুব্রতদা অসুস্থ। এবার একডালিয়ার পুজো কীভাবে হবে, সেটা ভাবছিলাম। যা হোক, এবার ব্যাপারটা হয়ে গিয়েছে।” এবারের পুজো শেষ। তারপর চলে গেলেন পুজো অন্তঃপ্রাণ মানুষটাও। কালীপুজোর দিন ক্লাব প্রেসিডেন্টের প্রয়াণের খবরে দীপ নিভে গেল ক্লাবেরও। একডালিয়ার সাবেকিয়ানা এবার ধরে রাখবেন কে? শুক্রবার বিকেলে তাঁর মরদেহ ক্লাবে নিয়ে যাওয়ার পর আক্ষেপের সুরে শুধু এটাই বলছেন ক্লাবের সদস্যরা।