অভিযোগ উঠছে, ব্রিটেনের মহিলা শল্য চিকিৎসকদের দুই-তৃতীয়াংশই কোনও-না-কোনওভাবে পুরুষ সহকর্মীর দ্বারা যৌন নির্যাতন এবং নিপীড়নের শিকার হতে বাধ্য হন। পরিষেবা দেওয়ার দপ্তরটির মধ্যেই যদি কোনও গোপন এবং গভীর অসুখ ঢুকে বসে আছে টের পাওয়া যায়, মানুষ সেক্ষেত্রে আলোড়িত, আতঙ্কিত হবেই। লিখলেন নবকুমার বসু।
ব্রিটেনের স্বাস্থ্য তথা চিকিৎসা দপ্তরে এক গোপন অথচ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাধির বিষয় সদ্য সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, এই সংবাদ দ্রুতগতিতে বিলেতের জনমানসে প্রবল আলোড়ন তুলেছে। এই আলোড়ন অথবা প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ এই যে, ব্রিটেন অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের জনসাধারণের শতকরা ৯০ ভাগ (৯০%) এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে নির্ভরশীল। এবং এই ব্যবস্থাপনাকে পৃথিবীর অন্যতম সবল স্বাস্থ্য পরিষেবা বলে স্বীকার করা হয়। সুতরাং, সেই পরিষেবা দেওয়ার দপ্তরটির মধ্যেই যদি কোনও গোপন এবং গভীর অসুখ ঢুকে বসে আছে টের পাওয়া যায়, মানুষ সেক্ষেত্রে আলোড়িত, আতঙ্কিত হবেই। গভীর অসুখটি কী?
১২ সেপ্টেম্বর ‘বিবিসি’ সংবাদমাধ্যম তাদের প্রতিটি প্রচারমাধ্যমে খোলাখুলি সম্প্রচার করেছে যে, ব্রিটেনের সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তর, যা ‘এনএইচএস’ (NHS: National Health Service) নামে পৃথিবী-বিখ্যাত, সেখানকার মহিলা শল্য চিকিৎসকদের দুই-তৃতীয়াংশই কোনও-না-কোনওভাবে পুরুষ সহকর্মীর দ্বারা যৌন নির্যাতন এবং নিপীড়নের শিকার হতে বাধ্য হন। এই শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা, এমনকী অপারেশন থিয়েটারে এবং অপারেশন চলাকালীনও ঘটে, ঘটে থাকে। আর যেহেতু অধিকাংশ শল্য চিকিৎসার সময়ই থিয়েটারে আরও বেশ কয়েকজনের উপস্থিতি স্বাভাবিক– যেমন জুনিয়র সার্জেন, নার্স, অ্যানেসথেটিস্ট, থিয়েটার অ্যাসিস্ট্যান্ট– সেজন্য যৌন নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনা যে খুব গোপনীয়তার মধ্যে সংঘটিত হয়, তা-ও না। সংক্ষিপ্ত এবং শরীরের নির্দিষ্ট কোনও একটা জায়গায় কাজ বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয়তা স্বাভাবিকভাবেই খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ এনে দেয়। আমি নিজে পেশায় শল্য চিকিৎসক বলেই জানি, একটু বড় অপারেশন বা পেটের অর্থাৎ অ্যাবডমিনাল সার্জারির সময়, পাশে এবং উলটোদিকে থাকা সহকারী বা সহকারিণীর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত আর-একজনের কানে আসতে পারে। কিন্তু চিকিৎসক এবং অত্যন্ত দায়িত্বশীল কর্মী হিসাবে তখন এতটাই তীব্র মনঃসংযোগ থাকে যে, অপারেশনের ওই নির্দিষ্ট কাটা এবং উন্মুক্ত জায়গাটুকু ছাড়া পৃথিবীর আর কিছুই চোখে এবং মনে থাকে না। কেননা, একটা ঘুম-পাড়ানো জীবন্ত মানুষের প্রাণ তখন সার্জেনের হাতে। আর সেই হাতে থাকে ধারালো এবং বিশেষভাবে নির্মিত বড়-মাঝারি-ছোট বা সূক্ষ্ম অস্ত্রশস্ত্র, যার সামান্য এদিকে-ওদিকে ঘুমন্ত মানুষটির প্রাণসংশয় হতে পারে।
[আরও পড়ুন: ভারতে ইসলামিক স্টেটের প্রশিক্ষণ শিবির! ৩০টি জায়গায় অভিযানে NIA]
ভাবতে অবাক লাগারই কথা এবং ততোধিক বিস্ময়ের যে, একটা সার্জিকাল অপারেশন করার সময় এবং সেই মানসিক স্থৈর্য ও প্রস্তুতির কালেও, কারও যৌনবোধের সচেতনতা থাকে, আসতে পারে! হ্যাঁ, শল্য-চিকিৎসক নামের কিছু মানুষরূপী পুরুষ প্রাণী, ওই পরিস্থিতিতেও সহকারিণী বা জুনিয়র মহিলা সার্জেনের জন্য কামোন্মাদনা অনুভব করেন। এবং চরিতার্থ করারও উদ্যোগ নেন।
‘বিবিসি’-র সাম্প্রতিক সম্প্রচারের পরেই অবসরপ্রাপ্ত শল্য চিকিৎসক লিজ ও’রিওর্দান স্পষ্ট ভাষায় মুখ খুলেছেন। জানিয়েছেন, তঁার শল্য-চিকিৎসক হয়ে ওঠার শিক্ষানবিশি পর্যায়ে, বছরের পর বছর ধরে, তাঁকে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নিপীড়ন ও নির্যাতনের পরে, তঁার তথাকথিত বস অথবা ট্রেনার বিশেষজ্ঞ শল্য-চিকিৎসকের শয্যাসঙ্গিনীও হতে হয়েছে। এই ধারাবাহিকতার সূচনা অপারেশন থিয়েটারে অ্যাসিস্ট করার সময় থেকে শুরু হলেও, ক্রমশ তা বিভিন্ন পার্টিতে, কনফারেন্সে এবং হোটেলের ঘরেও তঁাকে যেতে বাধ্য করেছে। লিজ আরও বলেছেন, পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবারই তিনি এই অন্যায় বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কথা ভেবেছেন। কিন্তু প্রতিবার একজন উঠতি সার্জেনের ভবিষ্যৎ এবং সীমাবদ্ধতার বিষয় মাথায় রেখে, চেপে যেতে হয়েছে। কেননা, একজন ট্রেনিং সার্জেনের সম্পূর্ণ কেরিয়ারটাই নির্ভর করে সেই লোকটির ওপর, যঁার রেফারেন্স ব্যতীত তঁাকে কেউ ‘সার্জেন’ বলে মানবে না। আর, যেহেতু শল্য-চিকিৎসা এমনই এক ধরনের পারফর্মিং কর্মকুশলতা, যা বই পড়ে বা ছবি দেখে শেখা সম্ভব না। শিখতে হবে কাজ করে করে, ছুঁয়ে-ছেনে, কেটে-ঘেঁটে এবং বাদ দিয়ে আবার জোড়া লাগিয়ে। আর, সেই সুযোগটা দিতে পারেন একজন সিনিয়র সার্জেন-ই, যঁার তত্ত্বাবধানে জুনিয়রকে কাজ করতেই হবে।
[আরও পড়ুন: সঞ্জয় মিশ্রের অবসর, ইডির অস্থায়ী প্রধানের দায়িত্বে রাহুল নবীন]
কিন্তু এবার লিজ মহিলা জুনিয়র সার্জেনদের এই বিষয়টা ‘#মিটু’ আন্দোলনের পর্যায়ভুক্ত করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন। অবসর গ্রহণের পরেও তিনি দেখেছেন, এখনকার মহিলা সার্জেনদের অভিজ্ঞতা, তঁার সময় থেকে কিছুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি। একটি সমীক্ষায় ১,৪০০ সার্জেনের মধে্য অর্ধেক মহিলাকে নিয়ে স্টাডি করা হয়েছে ‘ব্রিটিশ জার্নাল অফ সার্জারি’ নামের বিখ্যাত ম্যাগাজিনে। সেখানে স্বাধীন মতাদর্শের চিকিৎসকদের দিয়ে তথ্যানুসন্ধান করা হয়েছে। তার ফলাফলে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা বিস্ময়কর।
একটা মোটামুটি পরিসংখ্যান গ্রহণ করা যায় এইভাবে। যুক্তরাজে্যর সব হাসপাতাল এবং সব বিভাগের অথবা শাখার শল্য-চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ৬৩ হাজার। এর মধে্য শতকরা ২০ জন (২০%) মহিলা সার্জেন। কিছু কিছু শাখা– যেমন অপথালমোলজি, প্লাস্টিক সার্জারিতে মহিলার সংখ্যা বেশি। কিন্তু অর্থোপেডিক, কার্ডিয়াক, নিউরো সার্জারি ইত্যাদি বিভাগে মহিলা অপেক্ষাকৃতভাবে কম। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে যৌন হেনস্তা, নির্যাতন, নিপীড়নের ব্যাপারে শিক্ষানবিশি পর্যায়ে কোনও বিভাগই কম যায় না বলে বোঝা গিয়েছে।
শতকরা হিসাবটি এভাবেই ইংরেজি প্রতিশব্দ দিয়ে বলা যায়: হ্যারাসমেন্ট ৬৩%, সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট ৩০%, শারীরিক ঘনিষ্ঠতা ১১%, রেপ অথবা ধর্ষণ ১১%। এরপরের তথ্যটি আরও চমকপ্রদ যে, প্রায় ৯০% কর্মীই যঁারা হাসপাতালের থিয়েটার সংলগ্ন জায়গায় কাজ করেন, তঁারা এই ধরনের যৌন হেনস্তার ঘটনাগুলো দেখে থাকেন এবং দেখতে অভ্যস্ত। আর, দেখেও চুপ করে থাকেন।
সুতরাং, এর থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ট্রেনি অথবা উঠতি মহিলা সার্জেনদের প্রতি সিনিয়র, অভিজ্ঞ, কনসালট্যান্ট সার্জেনরা যৌন হেনস্তা করবেন এবং সেক্সুয়াল অ্যাডভান্টেজ নেবেন– এটা যেন এক অলিখিত নিয়ম, সিস্টেম এবং এটা যেন অন্যান্য স্টাফদের চোখে সয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদের প্রশ্নই ওঠে না। জুডিথ (পদবি উহ্য) নামের বর্তমানের এক কৃতী মহিলা সার্জেন নিজের অতীত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে যে, যঁার তত্ত্বাবধানে জুডিথ সার্জারির কাজ শিখেছেন, তিনি অপারেশন করার সময়ও মাঝে মাঝে জুডিথের বুকে, দুই স্তনের মাঝখানে (ক্লিভেজ) চোখ-নাক-মুখ ডুবিয়ে ঘষে নিতেন অবলীলায়। প্রথমবারের পরে জুডিথ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনার কি একটা টাওয়েল লাগবে ঘাম মোছার জন্য?’ (অপারেশন করার সময় প্রায়ই এটা দরকার হয় এবং নার্স অথবা ওটি অ্যাসিস্ট্যান্টরা তোয়ালে দিয়ে সার্জেনের মুখ মুছিয়ে দেয়) জুডিথের বস ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিলেন, ‘নো মাই ডিয়ার… তার থেকে এভাবে মুখ মুছে নেওয়াটা অনেক রিফ্রেশিং অ্যান্ড কুল।’
এছাড়াও মহিলা অ্যাসিসট্যান্ট কিংবা জুনিয়র সার্জেনের গায়ে, হাত ধোয়ার সময়, গাউন পরার সময়, এমনকী অপারেশনের সূচনা ও সমাপ্তির সময়ও, পুরুষাঙ্গ ঘষতে ঘষতে লিঙ্গোত্থান ও যৌন উত্তেজনার আনন্দ উপভোগ করার ঘটনাও যে বিরল নয়, কয়েকজন সে-কথা জানিয়েছেন। কিন্তু যদি বস হাতে ধরে কাজ না শেখায়, অপারেশন করার সুযোগ না দেয়, কীভাবে শরীরের কোন অপারেশনে কী ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে, কতটা চাপ দিতে হবে, কতটা গভীরে যেতে হবে, কতটা কাটতে হবে, হ্যামারেজ হলে কীভাবে ম্যানেজ করবে– এমন হাজারটা প্রশ্নের যদি উত্তর না-দেয়, তাহলে তার পক্ষে সার্জেন হওয়া মুশকিল। আর সেই ভয়েই মেয়েরা সহ্য করে যায়।
কিন্তু বহু দিন চেপে রাখা বিষয়টা এবার হঠাৎই কয়েকজন জুনিয়র ব্রিটিশ মহিলা সার্জেনের প্রতিবাদে একেবারে হঠাৎ আলোয় এসে পড়েছে। দু’-একজন প্রতিবাদ করতেই, ‘মিটু’ অান্দোলনের সমর্থক আরও কয়েকজন শল্য-চিকিৎসক মহিলা এগিয়ে এসেছেন। নড়েচড়ে বসেছে ‘ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেন’। টনক নড়েছে সরকারেরও। আর দেশটা শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড বলেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন এমপিকে নিয়ে কমিটি গঠন করেছেন, যঁারা এই সমস্ত বিষয়টি খুঁটিয়ে অনুসন্ধান করবেন। রিপোর্টে জানিয়েছে, গোপনীয়তা বজায় রেখেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সারতে হবে।
আসলে, এ-দেশের প্রায় সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা সরকারি, এবং স্বাস্থ্য দপ্তর সবথেকে বড়, এবং সবথেকে বেশি এই দপ্তরের কর্মীসংখ্যা বলেই, গভর্নমেন্টকে ব্যবস্থা নিতেই হবে এবার। ইতিপূর্বে ‘মিটু’ আন্দোলনের তীব্রতা এবং ২০১৭ সালে আমেরিকা থেকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এর প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে সরকার সতর্ক ও সজাগ।
এই নিবন্ধ তথা প্রতিবেদন লিখতে লিখতেই মনে পড়ছিল, সতি্যই তো, এই লেখকও যখন অনেক বছর আগে দেশে হাউস সার্জেন ছিল, সার্জিকাল ট্রেনিংয়ের জন্য কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে, পিজি-তে কাজ করেছিল, তখনও কি স্যরদের (পড়ুন কিছু কিছু সার্জেনের) এহেন প্রবণতার বিষয় লক্ষ করেনি! অস্বীকার করব না, উদার হৃদয় এবং হাতে ধরে কাজ শেখানোর স্যর, মাস্টারমশাই, সার্জেন অধ্যাপক যেমন পেয়েছি, তেমনই একটু স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী, যুবতী জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতি কিছু কিছু নামকরা অধ্যাপক-চিকিৎসক-সার্জেনের নেকনজরও কি টের পাইনি? অনেকেই পেয়েছে এবং জানে সেসব কথা। কিন্তু দেশেও কি বিলেতের মতো তার প্রতিবাদ/ প্রতিকার হবে!
(মতামত নিজস্ব)