সর্বজয়া রায়: জার্মানির কাছে সাত গোলের ক্ষত বোধহয় কস্মিনকালেও ভুলতে পারবে না ব্রাজিল। আর চব্বিশের লোকসভার দ্বৈরথে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যেভাবে গোলের পর গোল খেলেন শুভেন্দু অধিকারী, সম্ভবত রাজনৈতিক কেরিয়ারে তা তাঁর চিরকালীন দুঃস্বপ্ন হয়েই থাকবে। গোলরক্ষা তো দূরের কথা, ডিফেন্সেই যে এত ফাঁকফোকর থেকে যাবে শুভেন্দু বোধহয় তা স্বপ্নেও ভাবেননি।
অথচ ট্যাকল করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। রাজনীতির ময়দানে হাতে অস্ত্রও ছিল বহু। গত কয়েক বছরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে একাধিকবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। হেভিওয়েট নেতাদের জেলে যেতে হয়েছে। জনমানসে তৃণমূলের যে ভাবমূর্তি, তা অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেই ভাবছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কেকের উপর চেরির মতো শুভেন্দু হাতে পেয়ে গিয়েছিলেন নিয়োগ দুর্নীতি। গোটা বিরোধী শিবিরই এই নিয়ে শাসকদলের উপর ছিল খড়্গহস্ত। আক্রমণ শানিয়েছিল জোরদার। প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিজেপি তো সেই বিরোধিতার অস্ত্রে এগিয়ে ছিল কয়েক কদম। তার উপর চলে এল সন্দেশখালি। যুদ্ধের ময়দানে এত অস্ত্র পেয়েও যদি কেউ ব্যর্থ হন, তাহলে যে তিনি যুদ্ধের নিয়মই জানেন না, তা বললে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হয় না। শুভেন্দুর ক্ষেত্রে সে কথাই প্রযোজ্য। তিনি যত গর্জালেন, তত বর্ষালেন না। বস্তুত, বাংলায় গেরুয়া শিবিরের যে ভরাডুবি, তাঁর দায় অনেকটা তাঁরই।
ঠিক পাঁচ বছর আগেই ছবিটা ছিল উলটো। বাংলায় পদ্ম ফোটা তখন ছিল কষ্টকল্পনা। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরেছিলেন দিলীপ ঘোষ। ২০১৯-এ অপ্রত্যাশিত ফল করেছিল বিজেপি। ১৮টি আসন পেয়ে বিজেপির একটা নতুন রোডম্যাপ তৈরি করেছিলেন দিলীপ। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক রাজনৈতিক জল গড়িয়ে গিয়েছে। দিলীপ এখন আর দলের সভাপতিত্বের দায়িত্বে নেই। সে দায়িত্ব গিয়েছে সুকান্ত মজুমদারের হাতে, গত বিধানসভার সময় বিজেপি শিবির পেয়ে যায় শুভেন্দু অধিকারীকে। একদা তৃণমূল শিবিরের নির্ভরযোগ্য সৈনিক। অতএব তৃণমূল অন্দরের অলিগলি, কৌশল সবই তাঁর জানা। সেই অভিজ্ঞতার নিরিখেই দলে বাড়তি গুরুত্ব পেতে শুরু করেন শুভেন্দু। বলতে গেলে, তিনিই হয়ে ওঠেন বঙ্গে বিজেপির তুরুপের তাস। কেন্দ্রীয় নেতারা এসে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেন। তাঁর পরামর্শ মেনেই রণকৌশল ঠিক করেন। বিজেপির অন্দরে কান পাতলে শোনা যেত, লোকসভা ভোটের প্রার্থী নির্বাচনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ ব্যাপারে তাঁর উপরে আস্থাই রেখেছিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তৃণমূলকে মাটি ধরাতে শুভেন্দু প্রায় চষে ফেলেছিলেন গোটা বাংলা। চোখা আক্রমণে তৃণমূলকে ফালাফাল করেছিলেন। কিন্তু ভোটের বাস্তব বলছে, বাংলার মা, মাটি ও মানুষকে তিনি আজও সেভাবে চিনে উঠতে পারেননি। এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮-র মাইলফলক টপকানো তো দূরের কথা, শুভেন্দুর পরীক্ষাখাতায় প্রায় সর্বত্রই লাল দাগ। রিপোর্ট কার্ড বলছে, বঙ্গে বিজেপির অভিযানে তিনি চূড়ান্ত ব্যর্থ সেনাপতি।
[আরও পড়ুন: ভাঙল না মিথ, গণনার মাঝেই হার স্বীকার বিজেপি প্রার্থীর, রায়বরেলিতে জয় গান্ধীদের তৃতীয় প্রজন্মের]
অন্যদিকে তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলকে শুধু এগিয়ে নিয়েই যাননি, প্রায় ইতিহাসের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর জন্যও লড়াইটা মোটে সহজ ছিল না। নানা সময় তৃণমূল দল ও দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। বিরোধীরা প্রায় নিয়মিত আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ব্যতিবস্ত করে তুলতে চেয়েছে বঙ্গের শাসকদলকে। এখনও অনেক নেতা রাজনৈতিক কারণে জেলে। দলের মধ্যে মাঝে মাথাচাড়া দিয়েছিল নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঝামেলাও সামলাতে হয়েছে। খোদ অভিষেককেও বারংবার তলব করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তবে অভিষেকের সবথেকে বড় গুণ হল, ঠান্ডা মাথা। আর ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। অতএব সংগঠনের অ-আ-ক-খ তিনি ভালোই রপ্ত করেছেন। সেই 'যুব' সামলানোর সময় থেকেই সাংগঠনিক শক্তিতে শান দিয়েছিলেন অভিষেক। যত দিন গেছে তত এ ব্যাপারে পরিণত হয়েছেন তিনি। অতএব দলের অভ্যন্তরে যে ঝামেলা ছিল তা তিনি মিটিয়ে দিয়েছেন দক্ষ হাতেই। নবীনে-প্রবীণে ভারসাম্য এনেছেন। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পিত জনমুখী প্রকল্পের সুবিধা যাতে মানুষের কাছে পৌঁছয় তা নিশ্চিত করেছেন।
অভিষেককে তাই লড়তে হয়েছে দুটো লড়াই। একদিকে সর্বশক্তি নিয়েছিল ঝাঁপিয়েছিল বিজেপি। সেই বাইরের আক্রমণকে তিনি প্রতিহত করেছেন একজন দক্ষ নেতার গুণেই। অন্যদিকে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে এনেছেন 'নবজোয়ার'। সত্যি বলতে, তা কেবল একটা কর্মসূচি নয়। বরং তৃণমূলকে নয়া স্রোতে প্রবাহিত করতে ভগীরথ হয়ে উঠেছিলেন অভিষেক। একজন সেনাপতির মতোই লড়েছেন সামনে থেকে। দাঁড়িয়েছেন তাঁর সৈনিকদের পাশে। যুদ্ধ করেছেন যুদ্ধের মাটি চিনে, নিয়ম মেনে। ফল যা হাওয়ার তাই-ই হয়েছে। রেকর্ড ভোটে অভিষেকের জয় বুঝিয়ে দিয়েছে তৃণমূলের মতো একটি দলের ভবিষ্যৎ তাঁর হাতে একই সঙ্গে উজ্জ্বল এবং সুরক্ষিত। আর এর ঠিক পাশেই শুভেন্দুর কী অবস্থান? খানিকটা টার্গেট পূরণ করতে না-পারা 'এমপ্লয়ি'র মতোই। বিজেপি ভবিষ্যতে তাঁর জন্য কী ভেবে রেখেছে সে গেরুয়া শিবিরই জানে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, সে শিবির শুভেন্দুর হাতে মোটেও নিরাপদ নয়।
[আরও পড়ুন: ভোটের ফল নিয়ে মাথাব্যথা নেই! মিমি-নুসরতের সময় কাটছে কীভাবে?]
সৈন্য থাকলেই সেনাপতি হাওয়া যায় না। বুদ্ধি আর কৌশলের লড়াইয়ে শুভেন্দুকে পরাজিত করে অভিষেক যেন বুঝিয়েই দিলেন, সকলেই সেনাপতি নন, কেউ কেউ সেনাপতি।