দীপঙ্কর মণ্ডল: ফোনটা এসেছিল বারাণসী থেকে। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির লাগোয়া পান দোকানি। গতবছর ভোট কভারে গিয়ে মাঝরাতে যাঁর সঙ্গে আড্ডা হত। আমফানে এ রাজ্যের পান চাষিদের খোঁজ নিলেন তিনি। পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপকূল এলাকায় ঘুরে যা দেখেছি জানালাম। বললাম, আগামী অন্তত এক বছর উৎকৃষ্ট ‘বেনারসী পান’ পাবে না দেশবাসী। অভিশপ্ত ঘূর্ণিঝড় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে বাংলার উপকূল এলাকার সমস্ত পানের বরজ। আর তাই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন নগরী বারানসীই শুধু নয়, লখনৌ, গোরখপুর, দিল্লি, গুয়াহাটি, আমেদাবাদ, পাটনা-সহ ভারতের কোনও শহরে আপাতত এ রাজ্য থেকে পান যাওয়ার পরিস্থিতি নেই।
দেশের বিভিন্ন শহরে উৎকৃষ্ট মিঠা পানের সিংহভাগ যায় পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে পান চাষের সঙ্গে। সাগর, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, খেজুরি, রামনগর, কাঁথিতে কোনও বরজ আস্ত নেই। গত এক সপ্তাহে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর গাড়ি এই এলাকাগুলিতে চক্কর দিয়েছে। দিঘা থেকে রামনগর, কাঁথি হয়ে ঢুকলাম খেজুরি। দেশের প্রথম টেলিগ্রাফ চালু হওয়া জনপদের জনকা, হলুদবাড়ী, বারাতলা, নিজকসবা, কলাগাছিয়া এবং কামারদায় ঘুরে দেখলাম। যেন কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। মাটির বাড়ি একটাও দাঁড়িয়ে নেই। গামছা যেভাবে নিংড়ানো হয়, মোটা মোটা গাছ সেই ভাবে দুমড়ে-মুচড়ে রাস্তার উপর পড়ে। পান বরজের পাটকাঠি, খড়ের ছাউনি আর নারকেল পাতা দেখাই যাচ্ছে না। হয়তো সেগুলি উড়ে গিয়েছে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। পড়ে থাকা ছেঁড়া পাতা জানান দিচ্ছে সেখানে একটি পানের বরজ ছিল। এ দৃশ্য দেখেছি দিঘা, রামনগর ও নাচিন্দাতেও। হেঁড়িয়া, লাখি, টিকাশি, তল্লা, জাহানাবাদ, বাহারগঞ্জ থেকে শুরু করে খেজুরির উপকূল ভাগের সর্বত্র এক ছবি। ধ্বংস আর ধ্বংস।
[আরও পড়ুন : করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা, মহারাষ্ট্র ফেরত যুবককে বাড়িতে ঢুকতে বাধা প্রতিবেশীদের]
খেজুরি ২-এর বিডিও রমল সিং বির্দি পাড়ায় পাড়ায় চরকি পাক দিচ্ছেন। গাছ সরাচ্ছেন। তার মাঝে জানালেন, “আমাদের ব্লকে অন্তত দেড় হাজার পানের বরজ উড়ে গিয়েছে। প্রচুর বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। খেজুরি বন্দর সৎসঙ্গ আশ্রমও ক্ষতিগ্রস্ত। ধ্বংসের পুরো খতিয়ান এখনো হাতে আসেনি।” উত্তরবঙ্গের এই আমলা নিজে হাত লাগাচ্ছেন গাছ সরানোয়। এলাকায় প্রবল ক্ষোভ। বিদ্যুৎ নেই। ত্রিপল নেই। খাবার নেই। দিশাহারা সবাই। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও দেখা নেই। হেঁড়িয়ার জরানগরের বিমান নায়ক নিজের উদ্যোগে ত্রিপল বিলি করছেন। শতবর্ষ প্রাচীন কলাগাছিয়া জগদীশ বিদ্যাপীঠের প্রাক্তনী সমিতি, কামারদার তনুজ বেরা,কলাগাছিয়ার রত্নদ্বীপ সামন্ত, দুর্গা দাসরা দুস্থদের পাশে। খেজুরি এক নম্বর ব্লকের বিডিও তীর্থঙ্কর রায়ের কাছেও ধ্বংসলীলার পুরো খবর আসেনি। পঞ্চায়েতের বৈঠকের মাঝে তিনি জানালেন, এখনো সাতশো পানের বরজ নিশ্চিহ্ন হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে।
বাহারগঞ্জের শংকরপ্রসাদ দাসের কথায়, পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার উৎকৃষ্ট পান বিভিন্ন রাজ্যে চালান হয়। লকডাউনে তা বন্ধ। ঘূর্ণিঝড়ে বরজ ধ্বংস হওয়ায় অন্তত বছর খানেক ভাল মিঠা পান পাবে না দেশবাসী।
[আরও পড়ুন : স্থানীয় স্কুলে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার খোলায় তীব্র আপত্তি, ৬ ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ চাকদহে]
দীঘা থেকে ফিরে কলকাতা হয়ে গিয়েছিলাম কাকদ্বীপে। লট আটে গাড়ি রেখে ভটভটি ভাড়া করলাম। অনেক কসরত করে মুড়িগঙ্গা পেরিয়ে পা রাখলাম কচুবেড়িয়ায়। সাগরে পেলাম মারুতি ওমিনি। হ্যান্ডেল কেটকি গ্রাম হয়ে গাড়ি যাচ্ছিল। কোচা করে গামছা পরা এক মাঝ বয়সী মানুষ পাটকাঠি পড়ে থাকা জমিতে উবু হয়ে কী যেন করছেন। নিচে কিছু টাটকা সবুজ পাতা। গাড়ি দাঁড় করে এগোলাম। দেখি সেটি একটি মিষ্টি পানের বরজ। জমির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। বরজের কিছু লোহার রড ও কয়েকটি বাঁশ শুধু মাটিতে পড়ে। তার উপর পা দিয়ে এগোলাম। অনিল মাইতি নামে সেই পান চাষি জানালেন, প্রত্যেকটি বরজের আয়ু দশ থেকে কুড়ি বছর। তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় এক লক্ষ টাকা। দুটি বরজ ছিল তাঁর। ঝড়ে ধুলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। মাথার গামছাটি খুলে মুখ মুছলেন প্রৌঢ়। বিড়বিড় করে বললেন,” লকডাউনের ফলে দুমাস বাজারে পান যায়নি। মেদিনীপুরের মেচেদায় বেচতে যেতাম। সেই পান চলে যেত দেশের বিভিন্ন শহরে। সব শেষ হয়ে গেল।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক পি উলগানাথন জানালেন, শুধুমাত্র তাঁর জেলাতেই এক লক্ষ পানের বরজ ধ্বংস হয়েছে। আশার কথাও শুনিয়েছেন তিনি। ক্ষতিগ্রস্ত পানচাষিদের তালিকা নবান্নে পাঠানো হচ্ছে। তাঁদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি ক্ষতিপূরণের টাকা চলে যাবে। নতুন করে পানের বরজ তৈরির জন্য দেড় লক্ষ টাকা সাহায্য করবে রাজ্য সরকার।
The post আমফানে উড়ে গিয়েছে বরজ, দেশজুড়ে বাংলার মিঠা পানের আকাল appeared first on Sangbad Pratidin.