বিশ্বদীপ দে: ''সানিভাই, এবার অন্তত রানটা করো।'' তিরাশির বিশ্বকাপের সময় কপিল দেব ঠিক এই কথা বা এই রকমই কিছু একটা বলেছিলেন সুনীল গাভাসকরকে। ততদিনে বারো বছর ক্রিকেট খেলা হয়ে গিয়েছে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ওপেনারের। কপিল যতই অধিনায়ক হোন, সেই সময় মাত্র বছর পাঁচেক খেলছেন ভারতের হয়ে। তিনি গাভাসকরকে এভাবে বলায় সকলেই চমকে গিয়েছিলেন। চল্লিশ বছর আগে ফেলে আসা সেই ইতিহাস কিন্তু এবার ফেরেনি। অথচ সেবারের গাভাসকরের সঙ্গে এবারের বিরাট কোহলির দারুণ মিল। গোটা প্রতিযোগিতাতেই নীরব ছিল তাঁদের ব্যাট। কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে (T20 World Cup 2024 Final) ঘটে গেল অমিল। সানি ২ রানে আউট হলেও কোহলি করে গেলেন ৭৬ রান। আরও একটা অমিল। সেদিন কপিল গাভাসকরের পাশে না দাঁড়ালেও রোহিত শর্মা কিন্তু আগাগোড়া সমর্থনই জুগিয়েছেন তাঁর কমরেডকে। যা হয়তো বিরাট রাজার আত্মবিশ্বাসে ফুরফুরে অক্সিজেন জুগিয়ে গিয়েছে। সেটাই যে ফাইনালে কোহলি ম্যাজিকের ক্যাটালিস্ট নয়, কে বলতে পারে?
কপিল-গাভাসকর দ্বৈরথের কথা ক্রিকেট রসিক মাত্রই জানেন। এমনকী, ১৯৮৫ সালে শৃঙ্খলাভঙ্গে অভিযোগে কপিলকে টেস্ট দল থেকে বাদ দেওয়ার (ওই একবার তাঁর দল থেকে বাদ পড়া) পিছনে গাভাসকর ছিলেন, তাও শোনা যায়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য সব চুকেবুকে গিয়েছে। আজ তাঁরা খুবই ভালো বন্ধু বলে শোনা যায়। কিন্তু যখন খেলেছেন, তখন তাঁরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেলেছিলেন এমন কথা কিন্তু কেউ বলেন না। '৮৫-র যে টেস্টের কথা হচ্ছে, সেখানে দেশের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারকে বসানো হয়েছিল স্রেফ আগের টেস্টে বাজে শট খেলে আউট হওয়ার জন্য!
[আরও পড়ুন: কোপায় জয়ের হ্যাটট্রিক, অপরাজিত থেকে নকআউটে আর্জেন্টিনা]
তিরাশির বিশ্বকাপে ফেরা যাক। ৬টা ম্যাচ খেলে গাভাসকর করেছিলেন ৫৯ রান। একমাত্র বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ২১৪ তাড়া করতে নেমে ২৫ রানের একটা ইনিংস ছাড়া বলার মতো কিছুই তিনি করেননি। হ্যাঁ, ফাইনালে দুটি ক্যাচ হয়তো লুফেছিলেন। এটুকুই। বিশ্বসেরার লড়াইয়ে ভারত কিন্তু শুরুতে ছিল না। অথচ প্রথম ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামের 'গোলিয়াথ'কে উড়িয়ে 'ডেভিড' হয়ে ওঠে কপিলের টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু সেই সময় দলের সেরা ব্যাটারের ব্যাটই ছিল নীরব। দল নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, অথচ সানির স্কোর ছিল হতাশাজনক। যদিও যে দুটি ম্যাচে ভারত হেরেছিল, সেই দুই ম্যাচেই গাভাসকর খেলেননি। বাকিগুলিতে খেলেছিলেন এবং ব্যর্থ হয়েছিলেন। একসময় কপিল মেজাজ হারিয়ে বসেন। দলের সেরা দুই তারকার এই টক্কর বাকিদেরও হতবাক করে দিয়েছিল।
জাম্প কাট টু ২০২৪। প্রথমে মার্কিন মুলুক ও পরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে হওয়া টি২০ বিশ্বকাপে বিরাট কোহলির (Virat Kohli) মধ্যে কেমন যেন তিরাশির সুনীল গাভাসকরের ছায়া দেখা যাচ্ছিল। ভারত অবশ্য এবার কোনও ম্যাচেই হারেনি। তবু প্রশ্ন উঠছিল 'কিং'-এর পারফরম্যান্স নিয়ে। হয়তো হারলে সেই সমালোচনা আরও তীব্র হত। তবু অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, ওপেনিংয়ে জয়সওয়ালকে পাশে পেলে রোহিতের (Rohit Sharma) পক্ষে রান 'অ্যাক্সিলারেট' করা হয়তো আরও সহজ হত ইত্যাদি। কিন্তু রোহিত আস্থা হারাননি তাঁর সেরা ব্যাটিং অস্ত্রের উপরে। গোটা দুনিয়া যেখানে ভ্রূ কুঞ্চন করছে, সেখানে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে 'শর্মাজি কা বেটা' বলেছিলেন, ‘‘হি ইজ সেভিং ইট ফর দ্য ফাইনাল।’’ অর্থাৎ রান-টান করছে না এখন, একেবারে সবটা ফাইনালে গিয়ে করবে। কোনও সন্দেহ নেই কোহলির মতো রোহিতও একজন মহাতারকা। এবারের বিশ্বকাপে তাঁর ব্যাট চলেছে তলোয়ারের মতো। দলও জিতেছে একের পর এক ম্যাচ। পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দলকে হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে। অধিনায়ক ও খেলোয়াড়, উভয় দিক থেকেই সাফল্যের তরতরে নৌকোয় চড়ে বসেও তিনি ভোলেননি কোহলির কথা। ফর্মে না থাকা বিরাট রাজার কাঁধে তাঁর এই হাত রাখাটাই ফাইনালে সব কিছু বদলে দিল।
[আরও পড়ুন: অপ্রতিরোধ্য জার্মানি, ডেনমার্ককে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে মুসিয়ালারা]
শুরুতে রোহিতের উইকেট হারানোর ধাক্কার পর গোটা দেশ তাকিয়ে ছিল কোহলিরই ব্যাটের দিকে। এই পরিস্থিতিতে শিট অ্যাঙ্কর আর কেই বা হতে পারতেন তিনি ছাড়া! বিরাট ঠিকই করে নিয়েছিলেন পুরোটা খেলবেন। তাতে স্ট্রাইক রেট হয়তো কম থেকেছে। অর্ধশতরান এসেছে ৪৮ বলে। অর্থাৎ মোটামুটি একশো স্ট্রাইক রেট রেখে। যদিও শেষে এসে তিনি গাড়ি পঞ্চম গিয়ারে চালালেন। ৫৯ বলে করে গেলেন ৭৬। দুটি বিশাল ছক্কায় গ্যালারি মাতালেন। হাফ ডজন বাউন্ডারিও এল। ৩ উইকেটে ৩৪ হয়ে যাওয়া দল শেষ করল ১৭৬ রানে। কোহলির ইনিংস ছাড়া এটা হত কিনা তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু 'ম্যান অফ দ্য ম্যাচ' বিরাটের রানে ফেরা পাণ্ডিয়া বা অন্যদের উপর থেকে চাপ কমিয়ে দিয়েছিল একথা বলতেই হবে। আর এই সফল ইনিংসটিই তাঁকে তিরাশির গাভাসকার হতে দিল না। তৈরি করল এক অন্যতর রূপকথা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ফর্ম্যাট থেকে অবসর নিলেন কোহলি। আর শেষ প্রতিযোগিতায় বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন চ্যাম্পিয়নরা এভাবেই ফেরেন। ফেরেন বলেই তাঁরা চ্যাম্পিয়ন। ঘুসিতে ঘুসিতে তলিয়ে যেতে যেতেও ফিরে আসেন অসামান্য লেফট হুকে প্রতিপক্ষকে নকআউট করে। কিন্তু সাফল্যের সেই অপূর্ব সিঁড়িতে চড়ার সময় তাঁর পিঠে অধিনায়ক তথা দলের আর এক সুপারস্টারের আস্থাস্পর্শকেও (রাহুল দ্রাবিড়ের ভূমিকাও মনে রাখতে হবে) ভুললে চলবে না। ক্রিকেট যে টিম গেম সেকথা নতুন করে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন রোহিত-কোহলিরা। সেই সঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিলেন তাঁদের ঘিরে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত হিংসা-গসিপ, যা তারকাদের নিয়ে রটতেই থাকে।