কৃশানু মজুমদার: ২৩ মার্চ, ২০০৭। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ভারতের স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছিল।
২৯ জুন, ২০২৪। সেই ক্যারিবিয়ান ভূমেই বিজয়কেতন উড়ল।
দুটো দিনের মধ্যে প্রায় সতেরো বছরের ব্যবধান। কিন্তু কান্না-হাসি, দুঃখ-সুখ এসে মিশে গেল এক বিন্দুতে।একদিন যে ভূমিতে হেরে প্রস্থান ঘটেছিল, সেখানেই জুটল চ্যাম্পিয়নের বরমাল্য।
জীবন এরকমই। একদিকে সে সব ছিনিয়ে নেয়, নিঃস্ব করে দেয়। সেই আবার ফিরিয়ে দেয় দুহাত ভরে। জীবনের এই খেলা ভারতীয় দলের হেডস্যর রাহুল দ্রাবিড়ের থেকে ভালো আর কে জানেন! তিনি ভূয়োদর্শী। দীর্ঘ ক্রিকেটজীবনে উত্থান দেখেছেন। দেখেছেন পতনও। সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতার কদর্য রূপও দেখা হয়ে গিয়েছে তাঁর।
[আরও পড়ুন: চাপের মুখে চেনা কোহলির প্রত্যাবর্তন, ফাইনালে রাজকীয় বিরাট]
আজ শনিবার বার্বাডোজের মাটিতে তাঁর দলের ক্যাপ্টেন রোহিত শর্মার হাতে যখন কাঙ্খিত কাপটা উঠছে, রাহুল দ্রাবিড় (Rahul Dravid) কি অতীতে অবগাহন করছিলেন? নাকি বর্তমানকে আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি?
২০০৭ বিশ্বকাপের (৫০ ওভারের বিশ্বকাপ) আসর বসেছিল লয়েড-স্যর ভিভের ওয়েস্ট ইন্ডিজে।রাহুল দ্রাবিড়ের হাতেই ছিল অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। গুরু গ্রেগ ভারতীয় দলের কোচের হট সিটে। টিম ইন্ডিয়ার ধারণা তখনও শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেনি। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে ভারতীয় ক্রিকেটে কত ঘটনাই না ঘটেছে! মেগা মঞ্চে বিপর্যয় ঘটে দ্রাবিড়-সভ্যতার। প্রথমে বাংলাদেশ, পরে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে স্বপ্নের সলিলসমাধি ঘটে ভারতের। রাতের অন্ধকারে, পুলিশি প্রহরায় সোনার ছেলেরা থমথমে মুখে দেশে পা রাখেন।
সেদিন থেকে কোনও এক মহেন্দ্র সিং ধোনি বিশ্বজয়ের বীজ বুনেছিলেন মনের ভিতরে। রাহুল দ্রাবিড় নিশ্চয় সেসব অভিশপ্ত দিনের স্মৃতি মনে রাখেননি! অবশ্য রাখেননি বা বলি কীভাবে! ওই দুঃসময়ে হয়তো তিনি শপথ নিয়েছিলেন, এগিয়ে যেতে হবে।চ্যালেঞ্জ যতই আসুক, তা অতিক্রম করতে হবে।তাঁর তূণের অস্ত্র সততা, নিষ্ঠা এবং পরিশ্রম। ওই তিন অস্ত্রের সাহায্যেই কোচিং জীবনের শেষ স্টেশনে এসে ন্যায়বিচার পেলেন রাহুল দ্রাবিড়।
মনে পড়ে যাচ্ছে, তাঁরই বিখ্যাত সেই মন্তব্য, ''আশা ছাড়তে নেই। আপনি যে জিনিসে ভাল তাকেই আঁকড়ে ধরতে হয়।আপনি যেটা ভাল পারেন সেটা মনপ্রাণ দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে করুন। দেখবেন হয়তো কোথাও একটা
ন্যায়বিচার অপেক্ষা করে আছে। আসবেই এমন গ্যারান্টি নেই।কিন্তু আপনাকে পড়ে থাকতে হবে নিজের নিষ্ঠা নিয়ে।''
সততা, সংকল্পের আরেক নাম রাহুল দ্রাবিড়।ভারতীয় ক্রিকেটে দ্রাবিড়-জমানা শুরু হওয়ার পরে তাঁর দল বারংবার ব্যর্থ হয়েছে মেগা ইভেন্টে।সমালোচক, নিন্দুকদের নখ-দাঁতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন তিনি কিন্তু লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি।নিরলসভাবে করে গিয়েছেন নিজের কাজ।জানতেন একদিন সূর্য উঠবেই। অন্ধকার রাতের শেষে নতুন ভোর আসবেই।আজ সেই দিন।
কোচ দ্রাবিড় কি ছাপিয়ে গেলেন ক্রিকেটার দ্রাবিড়কেও? এনিয়ে তর্ক চলতেই পারে। ক্রিকেটার জীবনে অবিশ্বাস্য সব ইনিংস খেলেছেন তিনি।রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া সব বোলারদের শান্ত করেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের মিস্টার ডিপেনডেবল। তাঁর রক্ষণ ভাঙতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হত প্রতিপক্ষ বোলারদের। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে তিনি ভারতীয় ক্রিকেটে থেকে গিয়েছেন পার্শ্বচরিত্র হয়েই। বড় খেতাবও তিনি জেতেননি। দলের ক্যাপ্টেন হিসেবেও তিনি একনম্বর নন।২ নম্বর জার্সির আসল মালিক বোধহয় তিনিই।মহেন্দ্র সিং ধোনি বলতেন, দেড়শো কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা বল যখন ডিফেন্স করে রাহুল দ্রাবিড়, তখন সেটা আগ্রাসন নয়? বোলার ভিতরে ভিতরে ধ্বংস হয়ে যায়।
সেই রাহুল দ্রাবিড় হেডস্যর হয়ে রোহিত-ব্রিগেডকে বোধহয় জীবনের শিক্ষাই দিয়েছেন।নইলে ব্যর্থতার সঙ্গী হওয়া একটা দলকে নিয়ে কোচিং জীবনের শেষ স্টেশনে এসে কীভাবে এমন জয় সম্ভব! ফাইনাল ম্যাচ পেন্ডুলামের মতো দুলল।চাপ যখন প্রবল হয়ে শ্বাসরোধ করার উপক্রম করছে, তখনও হাল ছাড়েননি রোহিতরা।বিশ্বজয়ের আনন্দে রাহুল দ্রাবিড়কেও দেখা গেল শূন্যে ঘুসি ছুড়তে। কাপ হাতে নিয়ে উল্লাস করতে।
ফাইনালের (T20 World Cup Final 2024) আগে রাহুল দ্রাবিড়কে বলতে শোনা গিয়েছিল, ''আমার জন্য কাপ জেতার দরকার নেই। দলের একটা কাপ দরকার। সেটাই জিতুক।" টিম ইন্ডিয়া ভুবনজয়ী।২০০৭ সালের পরে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ভারত আবার বিশ্বসেরা।দ্বিপাক্ষিক সিরিজে রাজা আর আইসিসি টুর্নামেন্ট এলেই ফকির, এই ধারণা যখন কলকাতা থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, তখনই রাহুল দ্রাবিড়ের ভারত সেই ধারণাকে ক্যারিবিয়ান সাগরের জলে ভাসিয়ে দিল।
রাহুল দ্রাবিড় প্রমাণ করলেন তিনিই ভারতীয় ক্রিকেটের মিস্টার ডিপেনডেবল। তাঁর হাতেই সুরক্ষিত ছিল ভারতীয় ক্রিকেট।সব ভালো জিনিসেরই একদিন শেষ হয়।বিশ্বকাপের বল গড়ানোর আগে থেকে উচ্চকিত সুরে বাজছিল রাহুল দ্রাবিড়ের বিদায়ের রিংটোন।এদিনই তাঁর ভারতীয় দলের হেডস্যর হিসেবে শেষদিন। আগামিকাল থেকে তিনি প্রাক্তনের দলে।সরে যাওয়ার আগে রাহুল দ্রাবিড় যেন পূণ্যস্নান করলেন। ব্যর্থতা থেকে সাফল্য, দীর্ঘ যাত্রাপথের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করলেন।