নির্মল ধর: ছবির প্রোটাগনিস্ট সঞ্জীব মণ্ডল এক জায়গায় বলেছে, “কলকাতা শহরের যত জঞ্জাল এখানেই ফেলা হয়, তাই এখনকার মানুষগুলোর মধ্যে নোংরামি, শয়তানি, জীবনের কালো দিকগুলোর সমাবেশ বেশি ঘটে।” ঠিক তাই! ট্যাংরার বস্তি অঞ্চল কলকাতার অন্যান্য বস্তির থেকে অনেকটাই চেহারা চরিত্রে অন্যরকম। আর এখানেই সঞ্জয় মণ্ডল নামে এক তরুণ বছর ১০ আগে কচিকাঁচাদের নিয়ে একটা গানের দল (ব্যান্ড) বানিয়েছিলেন। গানের যন্ত্রপাতি বলতে ভাঙা ড্রাম, টিন, কৌটো, ঘণ্টা, কঞ্চি, কাঠি, বাটি, ঘটি। কোনও গিটার, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, তবলা, ব্যাঞ্জো, এককথায় প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সংগীত যন্ত্র ছিল না। সে দলের নাম ছিল ‘সঞ্জয় মণ্ডলের গানের দল’। যদিও বলা হচ্ছে সঞ্জয়ের বায়োপিক এই ছবি নয়, তবে চিত্রনাট্যের উৎস অবশ্যই সঞ্জয় মণ্ডল। যে কারণে ছবিতেও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের (Parambrata Chatterjee) নাম রাখা হয়েছে সঞ্জীব মণ্ডল।
লেখাপড়া না জানা বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে গানের দল বানানো টুকুই শুধু বাস্তব। গল্পের বাকিটা ফিকশন অর্থাৎ বানানো, সাজানো, কল্পিত। হ্যাঁ, সেই কল্পনায় ট্যাংরা এলাকার সমাজবিরোধীদের কর্মকাণ্ড যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিবেশটিও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে, পরিচালক সুপ্রিয় সেন (Supriyo Sen) বেশ কৌশল করেই জীবনের ডকুমেন্ট এলিমেন্টের সঙ্গে বাস্তবকে জড়িয়ে দিয়েছেন। আদতে সুপ্রিয় সেন তো তথ্যচিত্র নির্মাতা। একাধিক পুরস্কৃত, প্রশংসিত ছবি তাঁর ক্রেডিটে। এই ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ (Tangra Blues) তাঁর প্রথম ফিচার। তথ্যচিত্রের বীজটিকে নিয়ে তিনি কাহিনি চিত্রের গাছ তৈরি করেছেন। প্রথম ছবি হিসেবে তাঁর এই ভাবনটি প্রশংসার। একদিকে তিনি যেমন সঞ্জয় মণ্ডলের মতো এক তরুণের অভিনব কাজকে স্বীকৃতি দিলেন, আরেকদিকে সঞ্জয় ও তাঁর এলাকার একটি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ছবির তথ্য তুলে আনলেন কাহিনীর মোড়ক দিয়ে।
এদের মাঝখানে এসে পড়ল এক বিত্তবান বাবার জয়ী (মধুমিতা সরকার) নামের তরুণী মেয়ে। যে নিজে গান তো করতই পাশাপাশি গানকে অন্তর দিয়ে ভালবাসে। নিজস্ব প্যাশন থেকে। তার কাজ অনেকটা ট্যালেন্ট হান্টারের মতো। জানা গেল, কলকাতায় আসার আগে সে ব্রাজিলের বস্তিতেও এমন কাজ করেছিল। সঞ্জীবের খোঁজ সে পায় ব্যান্ডের খুদে গায়ক চালুর (সামিউল আলম) কাছ থেকে। আর জয়ী এদের আবিষ্কার করে উচ্চবিত্ত ফ্ল্যাটবাড়ির জঞ্জাল কুড়ানির চেহারায়।
[আরও পড়ুন: পয়লা বৈশাখে প্রকাশ্যে ‘গোলন্দাজ’ ছবির টিজার, নগেন্দ্রপ্রসাদের ভূমিকায় দুর্দান্ত দেব]
ছবির শুরু ২০০৯ সালে। দু’মিনিট বাদেই সময় বদলে যায় ২০১৯ সালে। রাজ্যে রাজনীতির শুধু নয়, পাড়ার রাজনীতিতেও তখন পুলিশ, মাস্তানদের এক জোড়া সিন্ডিকেট চালু হয়েছে। এলাকা দখল তো বটেই সেই সঙ্গে বস্তি উচ্ছেদ করে ও বন্ধ কারখানার জায়গা জবরদখল করে হবু প্রোমোটারদের হতে জমি তুলে দেওয়ার সামাজিক কুনাট্যকেও সুপ্রিয়র চিত্রনাট্য ছেড়ে কথা বলেনি। আর এখানেই ছবিটি হয়ে ওঠে সমসাময়িক এক দলিল। সঞ্জীব মণ্ডলের গানের দল তৈরি নিয়েও আকচাআকচি কম ছিল না। জয়ী চায় ১০ বছর আগের সুরকে আরও বেশি সময়োপযোগী করে তুলতে চায়। আনতে চায় জোশ। সঞ্জীবের সঙ্গে সেই নিয়ে কিঞ্চিৎ বিরোধ হয়। দলের কিশোর গায়ক চালু তার নতুন দিদিকে ফলো করতে চায়। সঞ্জীব চায় না তার এতদিনের শিক্ষা বদলে যাক। ছেলেরা গান নিজেরাই লেখে নিজেদের জীবন থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা, অভিঘাত থেকে। ছোটবেলার পড়া “বাবুরাম সাপুড়ে…” বা ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে…” ছড়াকেই তারা নিজের জীবনের চেনাজানা ঘটনা, অনুভূতির রঙে এক নতুন চেহারা দিয়ে প্রতিবাদের গান করে তোলে।
আমার মনে হয়েছে এমন মিউজিক্যাল সিনেমার পূর্বসূরি অঞ্জন দত্তের থেকে ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ এখানেই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। এবার ছবির কাঠামোয় ঢোকানো হয়েছে ব্যান্ড দলের প্রতিযোগিতা ও চালুর মৃত(খুন হওয়া) বাবাকে নিয়ে কিঞ্চিৎ নাটক। সেটারও সমাধান ঘটে যায় সিনেমাটি লাইসেন্সের কৌশলে। অভিমানে সরে থাকা চালু শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতার মঞ্চে উঠে নিজের ভেতরের দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট আর প্রতিবাদের সুরে কণ্ঠ ছেড়ে গেয়ে ওঠে “গল্প নয়, ছিল সত্যিকারের দিন / গল্প নয়, যা বলছি সত্যিই / বাঁচতে চাওয়ার ছিল না শক্তি / এটাই আমার জীবন বুঝবি রে তোরা মন দিয়ে শোন…”। এই গানের ভাষা ও পরিবেশনের ভঙ্গীই ‘ট্যাংরা ব্লুজ’কে চ্যাম্পিয়ন করে দেয়।
চালুর কিশোরী বন্ধু অভিমান সরিয়ে কাছে আসে। জয়ী হয়তো এই বস্তির কাজ শেষ করে আবার কোনও বস্তির দিকে এগিয়ে যাবে। সঞ্জীব মণ্ডল থাকবে জীবনের লড়াইয়ে এদের নিয়েই। প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার পর বনফায়ারের দৃশ্য দিয়ে ছবির শেষ। কিন্তু সত্যিই কি শেষ? নাকি নতুন করে শুরু? সেই নীরব ইঙ্গিত কিন্তু ছবিতে রেখেছেন সুপ্রিয়। শুধু প্রেমের আর প্রতিবাদের বানানো গান নয়, ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ এক ঝাঁক স্লামডগ মিলিয়নের ক্যাকোফোনির মধ্যেও জীবনের জয়গান। আর এখানেই সুপ্রিয় ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সমবেত প্রয়াসের সাফল্য। কারণ পরমব্রত এই ছবির ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসারও বটে।
পরমব্রত, মধুমিতা (Madhumita Sarcar), ঋষভ বসুদের পাশে দাঁড়িয়ে সামিউল আলম, ঐশানী, আত্মদীপ-সহ একঝাঁক ছেলেমেয়ে অভিনয়ের সুন্দর সঙ্গত করেছেন। বিশেষ করে সামিউল। ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ থেকে সে অনেকটাই পরিণত। বেশ সাবলীল, আবার আনকোরা বিষয়টিও রয়েছে। ভালো প্রশিক্ষণ পেলে ছেলেটি এগোবে। এখানে ওর মায়ের ভূমিকায় স্নেহা বিশ্বাসকে দেখতে পেলে আরও ভাল লাগতো। এই ছবির আর একটি দর্শনীয় গুণ হলো রঞ্জন পালিতের মুড ফটোগ্রাফি। পরিবেশ, ঘটনার সময়, চরিত্রের মানসিক অবস্থার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আলো-আঁধার, কালো, উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার রঞ্জনের গভীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। বেশ কয়েকটি জায়গায় ফ্রেমিংয়ের কোরিওগ্রাফি একেবারে বাস্তবের হুবহু প্রতিবেদন। সাবাস রঞ্জন! আর বাকি রইল গান ও আবহ। সেখানেও স্কোর করেছেন নবারুণ বসু। হাততালি দেওয়ার মতো কাজ। এই অতিমারীর আক্রমণের মুখে ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ সত্যিই কোনও আশার আলো দেখাতে পারে কিনা, সেটাই লক্ষ্য রাখার। প্রায় তারকাহীন ছবি বাজিমাত করতে পারে শুধু বিষয়ের জোরে আর আন্তরিকতার জোশ দিয়ে। শহরের আন্ডারবেলিতেও যে জীবনের ফল্গু স্রোত তিরতিরিয়ে বয়ে চলে তারই এক জীবন্ত দলিল এই ‘ট্যাংরা ব্লুজ’। হ্যাঁ অনেক খামতি নিয়েও বুক চিতিয়ে সত্যি কথাটা অন্তত বলতে চেষ্টা করেছে।