shono
Advertisement

Breaking News

বশ মানাতে পারতেন বাঘ-সিংহকে, ব্রাজিলীয় সেনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই বাঙালি যুবক!

জেনে নিন বীর বাঙালি কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের কাহিনি।
Posted: 07:29 PM Jun 03, 2022Updated: 09:00 PM Jun 03, 2022

বিশ্বদীপ দে: ‘… তার মন উড়ে যেতে চায় পৃথিবীর দূর দূর দেশে শত দুঃসাহসিক কাজের মাঝখানে। লিভিংস্টোন, স্ট্যানলির মতো, হ্যারি জনস্টন, মার্কো পোলো, রবিনসন ক্রুসোর মতো। এর জন্যে ছেলেবেলা থেকে সে নিজেকে তৈরি করেছে- যদিও একথা ভেবে দেখেনি অন্যদেশের ছেলেদের পক্ষে যা ঘটতে পারে, বাঙালি ছেলের পক্ষে তা ঘটা এক রকম অসম্ভব।’ গত শতকের তিনের দশকে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন ‘চাঁদের পাহাড়’। বাঙালির বড় আপন এক আখ্যান। এই উপন্যাসটি লেখার সময় শঙ্কর চরিত্রটি সৃষ্টি করতে গিয়ে কি তাঁর মাথায় ছিল এক বঙ্গসন্তানের কথা? পরবর্তী সময়ে সত্যজিতের ফেলুদা কাহিনিতেও উল্লেখ মিলেছিল যাঁর। তিনি কোনও কাল্পনিক চরিত্র নন, রক্তমাংসের চরিত্র। কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস (Suresh Biswas)। ঘরছাড়া হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। যাঁর বশ্যতা স্বীকার করত হিংস্র বাঘ-সিংহরা। সুদূর ব্রাজিলের (Brazil) মাটিতে মাত্র ৫০ জন সেনাকে নিয়ে যিনি নৌবাহিনীর বিদ্রোহ রোধ করতে অসংখ্য বিদ্রোহীকে আটকে দিয়েছিলেন। এমন আশ্চর্য জীবনকথা শুনতে বসলে সত্য়িই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

Advertisement

বাঙালির গায়ে একটা লেবেল বরাবরই লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা অলস। বসে বসেই জগৎ জয় করে ফেলে তারা। যদিও এই ধারণাকে নস্যাৎ করেছেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন। দেশে আর ফেরা হয়নি। ব্রাজিলের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন ৪৪ বছর বয়সে। মাঝের ৩০ বছর তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন কত না দেশ! কাজ করেছেন সার্কাসে। সেখান থেকে সেনাবাহিনীতেও হয়ে উঠেছেন অপরিহার্য। সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে হয়ে উঠেছেন সমাজের এক সম্মাননীয় ব্যক্তি। এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের কাহিনি সত্য়িই যেন রূপকথাকে হার মানায়। 

সুরেশ বিশ্বাস

[আরও পড়ুন: পুরীর জগন্নাথ মন্দির করিডরে সায় সুপ্রিম কোর্টে, খারিজের আরজি ওড়াল শীর্ষ আদালত]

১৮৬১ সালে নদিয়ার নাথপুরে জন্ম সুরেশ বিশ্বাসের। কৃষ্ণনগর থেকেই ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তাঁদের গ্রাম। পরে তাঁর পরিবার উঠে আসে কলকাতায়। শৈশব থেকেই দুরন্ত সুরেশের মন বসত না নিরিবিলি দিনযাপনে। মনের মধ্যে তিনি শুনতে পেতেন অজানার ডাক। বাবার সঙ্গে মতবিরোধের পরে বাড়ি ছাড়েন তিনি। কলেজের অধ্যক্ষ আটসন সাহেবের কাছে আশ্রয় নিলেন। এই সময়ই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। সাহেবই ব্যবস্থা করে দিলেন কলেজের হস্টেলে থাকার। ক্রমে স্পেন্সেস হোটেলে ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ জুটিয়ে নিলেন সুরেশ। আর সেই সুবাদে প্রায়ই জাহাজ ঘাটে যাওয়া। এই সময় থেকেই তাঁর মনের মধ্যে দেশের বেড়া ডিঙিয়ে সুদূরে পাড়ি দেওয়ার বীজ ক্রমেই পরিণত হতে তাকে মহীরুহে।

কিন্তু চাইলেই কী হয়? প্রথমে সুরেশ গেলেন রেঙ্গুনে। কিন্তু সেখানে তেমন কিছু সুবিধা হল না। ফিরলেন দেশে। তবে তার আগে এক মগ যুবতীকে বাঁচালেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। সেই যুবতী রাতারাতি প্রেমে পড়লেন সুরেশের। সুরেশও যে আকর্ষণ অনুভব করেননি তা নয়। কিন্তু সেই আকর্ষণের থেকেও তাঁর কাছে তখন অনেক বেশি আকর্ষণীয় অজানার আহ্বান। তাই শেষ পর্যন্ত সেই প্রেমিকাকে ছেড়ে মাদ্রাজে (আজকের চেন্নাইয়ে) ফিরে এলেন সুরেশ।
কিন্তু দেশে ফিরেও অবস্থার পরিবর্তন হল না। চাকরি নেই, পকেটে পয়সা নেই। অবস্থা এমন দাঁড়াল, আত্মহত্যার পথ ছাড়া আর কোনও পথই নজরে আসছিল না তাঁর। সেই সময় এক সাহেব তাঁকে পরিচারকের চাকরি দেন। কিছুদিন সেই কাজ করার পরে কলকাতায় ফিরে আসেন সুরেশ। কিন্তু মনের কোণে জ্বলজ্বল করছে শিকড় ছিঁড়ে দেশ ছাড়ার আকাঙ্ক্ষা।
শেষ পর্যন্ত ১৮৭৮ সালে এল সুযোগ। সহকারী স্টুয়ার্ডের পদে যোগ দিয়ে বিলেতে পাড়ি দিলেন। লন্ডনের সেই দিনযাপনও খুব সহজ ছিল না ১৭ বছরের কিশোরের। পেট চালাতে কখনও কাগজ বিক্রি, কখনও মুটের কাজ। সেই সঙ্গেই চলল পড়াশোনাও। ধীরে ধীরে রসায়ন, জ্যোতিষ কিংবা গণিতের মতো বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠলেন তিনি।

রাগী সিংহও অনায়াসে বশ মানত সুরেশ বিশ্বাসের কাছে

[আরও পড়ুন: বাড়ছে করোনা। বিমানবন্দরগুলিতে ফের মাস্ক পরা নিয়ে কড়াকড়ির নির্দেশ দিল্লি হাই কোর্টের]

এর পরই তিনি কাজ পেলেন একটি সার্কাসে। বেতন সপ্তাহে ১৫ সিলিং। এই চাকরিই মোড় ঘুরিয়ে দিল তাঁর জীবনের। কেন্টের সেই সার্কাস দলে সুরেশ ছিলেন পশু প্রশিক্ষক। বন্য পশুরা অনায়াসেই তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিত। সেই তালিকায় ছিল পশুরাজ সিংহও। ব্রিটেনের সংবাদপত্রে প্রশংসা পেল নবাগত তরুণের এই বিক্রমের কাহিনি। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন সুরেশ বিশ্বাস। দৃঢ়চেতা অনমনীয় পৌরুষের আবেদনে হৃদয় হারালেন দলেরই এক জার্মান যুবতী। যদিও পরে মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে দেশে ফিরে যান সেই যুবতী।

এদিকে সার্কাসের কাজ ছেড়ে দিয়ে জার্মানিতে আসেন সুরেশও। প্রেমিকার খোঁজে নয়। পশু প্রশিক্ষকের চাকরি করতে। শোনা যায়, এই সময় ফ্যানি নামের একটি বাঘকে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। রাতারাতি অতিকায় সেই বাঘ যেন পোষ্য হয়ে যায় সুরেশ বিশ্বাসের।

কিন্তু এরপরই আচমকা সেই জার্মান যুবতীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তাঁর। ফের তৈরি হল সম্পর্ক। আর তাতেই ঘনিয়ে এল বিপদ। সেই যুবতীর এক প্রেমিক-সহ আত্মীয়রা রীতিমতো প্রাণে মেরে ফেলার চক্রান্ত করেছিলেন সুরেশকে। শেষ পর্যন্ত জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দিতে হল। সেখান থেকে ব্রাজিলে। সুরেশই প্রথম ভারতীয় যিনি ব্রাজিলের মাটিতে পা রাখেন।

এই ব্রাজিলেই জীবনের সেরা মুহূর্তটি অপেক্ষায় ছিল তাঁর জন্য। একদিকে সার্কাসের খেলা দেখানো। অন্য দিকে নানা ভাষায় বক্তৃতা দেওয়া! আসলে বাংলা ছাড়াও সাতটি ভাষায় ততদিনে তিনি পারদর্শী। নানা বিষয়ে জ্ঞান সত্য়িই অবাক করে দিত। বাঙালি যুবকটির নায়কোচিত ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হতে লাগল সকলে। ব্রাজিলের এক চিকিৎসকের সুন্দরী কন্যাও বাদ গেলেন না। শেষ পর্যন্ত ডেসডিমোনা নামের সেই তরুণীকেই বিয়ে করেন সুরেশ। যোগ দেন ব্রাজিলের সেনাবাহিনীতে। উন্নতিও হল লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রথমে কর্পোরাল। পরে সেখান থেকে সার্জেন্ট। এরপর ১৮৯৩ সালে লেফটেন্যান্ট। যদিও মজার বিষয় হল, কর্নেল কিন্তু হতে পারেননি তিনি। হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন। স্রেফ ‘রেসিজমে’র রক্তচক্ষুতে ‘নেটিভ’ সুরেশের আর কর্নেল হওয়া হয়নি। তবুও সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তিনি কর্নেলই হয়ে গিয়েছিলেন। কেন? এবার সেই প্রসঙ্গ।

বাংলা কমিক্সেও ফিরে এসেছে কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের প্রসঙ্গ

সেই সময় নৌবাহিনীতে দেখা দিল সেনা বিদ্রোহ। ব্রাজিলের নাথেরেয় শহরে হামলা চালাল তারা। এদিকে সেই শহরের সেনাবাহিনীতে তখন মাত্র ৫০ জন সেনা। দায়িত্ব নিয়ে সেই লড়াইয়ে অংশ নিলেন সুরেশ। তাঁর নেতৃত্বে সেই অসম যুদ্ধে জিতল ব্রাজিলের সেনা। সেই জয়েই তিনি হয়ে উঠলেন সকলের মনের নায়ক।

১৯০৫ সালে মৃত্যু হয় সুরেশ বিশ্বাসের। দেশে আর ফেরা হয়নি বাংলা মায়ের দামাল এই সন্তানের। কিন্তু তাঁর বীরত্বের কাহিনি ঘুরতে ঘুরতে যখন এসে পৌঁছেছিল এদেশে তখন গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল তাঁর আপনজনদের। একদিন অভিমান করে যে ছেলে ঘর ছেড়েছিল, সে বিশ্বকেই করে তুলেছিল তার ঘর। আর একা হাতে চুরমার করে দিয়েছিল বাঙালির ঘরকুনো হওয়ার অপবাদ। হয়ে উঠেছিল রূপকথার এক নায়ক, রক্তমাংসের শরীরেই।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
toolbarHome ই পেপার toolbarup ছাঁদনাতলা toolbarvideo শোনো toolbarshorts রোববার