বিশ্বদীপ দে: অতিমারী (Pandemic)। গত এক বছর ধরে এই শব্দটিকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। সেই সঙ্গে মনের ভিতরে ছোঁয়াচে অসুখের আস্তানা গজিয়ে ওঠা। লকডাউনের শুনশান দৃশ্যপট পেরিয়ে স্বাভাবিকতার দিকে বাঁক নিতে নিতে ফের আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সংক্রমণ। এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বরং ইতিহাসকে একবার ছুঁয়ে দেখা যাক। এই লেখার বিষয় এমন এক ছোঁয়াচে অসুখ, যার কথা শুনলে প্রথমেই মনে হবে নেহাতই বানানো গল্পকথা। কিন্তু তা তো নয়। অতীতের পৃথিবীর রীতিমতো সত্যি কাহিনি হয়ে আজও ইতিহাসের অংশ হিসেবে রয়ে গিয়েছে এই অভিনব প্লেগের স্মৃতি। ‘ডান্সিং প্লেগ’ (Dancing plague) নামেই যার পরিচিতি।
পাঁচশো বছর আগের কথা। ফ্রান্সের (France) স্ট্রসবার্গ (Strasbourg) শহর। যদিও তখন তা রোমের অধীনস্থ। ১৫১৮ সালের জুলাই মাসের প্রবল গরমে সেঁকাপোড়া একটা দিন। হঠাৎই পথে নেমে পড়লেন ত্রোফিয়া। পথই হয়ে উঠল মঞ্চ। নাচের মঞ্চ। নাচতে শুরু করে দিলেন সেই তরুণী। একেবারে অকস্মাৎ! সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। আশপাশে ভিড় জমতে সময় লাগল না। কিন্তু ত্রোফিয়ার কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি নেচে চলেছেন নিজের মনে। যেন সব আগল ভেঙে, সমস্ত নিয়ন্ত্রণ চুরমার করে নিজের সত্তাকে ভাসিয়ে দেওয়া এক অনন্ত প্রবাহের ভিতরে। নাচতে নাচতে মত্ত ত্রোফিয়াকে ঘিরে এবার একটা অন্য ভিড় জমল। এঁরা দর্শক নন, অংশগ্রহণকারী। বেশির ভাগই কমবয়সি মহিলা। তাঁরা নাচতে লাগলেন ত্রোফিয়াকে ঘিরে। চলতে থাকল নাচ।
[আরও পড়ুন: এই না হলে প্রেম! পাঁচ দশক পেরিয়ে বিদেশিনী প্রেমিকাকে ফিরে পেলেন রাজস্থানের বৃদ্ধ]
এমন করে কাটল ৬ দিন! প্রতিটি দিনের শেষে নাচতে নাচতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তেন ত্রোফিয়া। পা তখন রক্তাক্ত। কিন্তু আবার সম্বিৎ ফিরে পেতেই শুরু হয়ে যেত নাচ। যেন নাচ ছাড়া এজীবনে তাঁর আর করণীয় কিছু নেই। একই অবস্থা ভিড়ের বাকিদেরও। তাঁদেরও অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদভ্রান্তের মতো এই উন্মাদের নৃত্য বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণই দেখা গেল না। কথিত আছে, মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়া এই ছোঁয়াচে নাচের অসুখে নাকি সেই সময় গড়ে ১৫ জন করে মানুষ মারা গিয়েছিলেন! শরীরের ওপর অমানুষিক ধকল ডেকে আনতে লাগল স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের মতো অসুখ।
স্বাভাবিক ভাবেই এমন পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকতে চায়নি শাসকরা। সংগীতজ্ঞদের ভাড়া করে শহরের টাউন হলে আনা হল। উদ্দেশ্য, বিষে বিষক্ষয়ের মতো মিউজিক শুনিয়ে নাচিয়েদের আরও নাচতে উৎসাহ দেওয়া। কিন্তু তাতেও ফল হয়নি। বরং ক্রমশ বাড়তে থাকে নাচতে থাকা মানুষের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ে মৃতের সংখ্যা!
কিন্তু সত্যিই কি বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই আশ্চর্য অসুখে? সে সম্পর্কে কিছু হলফ করে বলা মুশকিল। স্ট্রসবার্গ শহরের নথি ঘেঁটে দেখা যায় সেখানে মৃতের সংখ্যা কিছু দেওয়া নেই। এমনকী, আদৌ কেউ মারা গিয়েছিলেন কিনা তাও উল্লেখ করা হয়নি। ফলে এই অসুখে মৃতের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা আজও কাটেনি।
তবে ‘ডান্সিং প্লেগ’ কিন্তু মোটেই ইউরোপের (Europe) প্রথম ও একমাত্র নাচের প্লেগের উদাহরণ নয়। ইএল ব্ল্যাকম্যান তাঁর ‘রিলিজিয়াস ডান্সেস ইন দ্য ক্রিশ্চিয়ান চার্চ অ্যান্ড ইন পপুলার মেডিসিন’ বইতে দাবি করেছেন, ‘ডান্সিং প্লেগ’ প্রথম দেখা যায় সপ্তম শতকে। কোলবিক নামের এক স্যাক্সন শহরে আচমকাই কয়েক নাচতে শুরু করে দেন। তাও আবার কবরখানায়!
[আরও পড়ুন: করোনা রুখতে গঙ্গাজলই ভরসা, সঙ্গে মন্ত্রপাঠ! আজব কাণ্ড যোগীরাজ্যের থানায়]
সেই শুরু। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই এমন নজির মিলেছে। যার মধ্যে সব থেকে ভয়ঙ্কর ১৩৭৪ সালের ঘটনাটি। তার ঠিক আগে গোটা ইউরোপে তাণ্ডব চালিয়েছে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ মহামারী। কার্ল হেকার তাঁর ‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ অ্যান্ড দ্য ডান্সিং ম্যানিয়া’ বইয়ে সবিস্তারে লিখেছেন ১৩৭৪ সালে জার্মানিতে ‘ডান্সিং প্লেগ’-এর প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে। তাঁর বর্ণনায় রয়েছে, ”ওরা সবাই হাত ধরাধরি করে বৃত্ত তৈরি করে নিচ্ছিল। কারও কোনও হুঁশ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেচে চলেছে।” বেশ কয়েক দিন ধরে চলতে থাকা এই প্লেগে পাঁচশো থেকে এগারোশো মানুষের আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা যায়। এমন করে অন্তত ১০টি নজির লক্ষ করা যায় ইতিহাসে। তবে স্ট্রসবার্গই সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
কিন্তু কেন? কোন কারণে এই অদ্ভুত ব্যামোতে আক্রান্ত হয় মানুষ? এবিষয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ট্যারান্টুলা মাকড়সার কামড়ই এমন অদ্ভুত আচরণের পিছনে থাকা আসল কারণ। তবে একই সময়ে একাধিক মানুষের আক্রান্ত হওয়া তাতে যেন ঠিক ‘জাস্টিফাই’ হয় না। তাই ওই তত্ত্ব ধোপে টেকে না। আরেকটা জনপ্রিয় থিয়োরি হল এরগট নামের এক ছত্রাক থেকেই নাকি ছড়িয়েছিল এই অসুখ। রুটির মধ্যে গজায় এই ছত্রাক। কিন্তু এই তত্ত্বও অনেকে উড়িয়ে দেন। তাঁদের যুক্তি, একসঙ্গে এত বেশি লোকের একই সময়ে ওই ছত্রাকের রাসায়নিকের প্রভাবে আক্রান্ত হওয়াটা অবাস্তব।
এরই পাশাপাশি রয়েছে আরও এক থিয়োরি। সেটা মনস্তাত্ত্বিক। একটু আগে ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর (Black Death) কথা বলা হয়েছিল। সাধারণত এমন মহামারী কিংবা অন্য কোনও সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব মানুষের মনে পড়ে। এক ইতিহাসবিদ জন ওয়ালার এপ্রসঙ্গে তুলে এনেছেন স্ট্রসবার্গের ‘ডান্সিং প্লেগ’-এর প্রেক্ষাপট। তাঁর কথায়, সেই সময় ওখানকার নাটকীয় অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক সংঘাতের আবহ এই অসুখের মঞ্চকে তৈরি করে দিয়েছিল। যার ফলে জন্ম নিয়েছিল এক গণ হিস্টিরিয়া কিংবা সাইকোসিস। হয়তো খিদে, অসুখের দাপট থেকেই এই মানসিক বৈকল্য জন্ম নিয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী, যত বার এই প্লেগ ফিরে এসেছে ততবারই এমন ধরনের পরিস্থিতি ছিল।
এতগুলি শতক পেরিয়ে এসেও মানুষ এই আশ্চর্য অসুখকে ভোলেনি। ভোলেনি স্ট্রসবার্গকে। ‘স্ট্রসবার্গ ১৫১৮’ নামের এক থিয়েটার রয়েছে, যেটির পরিচালনা ও কোরিওগ্রাফি করেছেন লুসি মারিনকোভিচ। গত মাসে নিউজিল্যান্ড ফেস্টিভ্যালেও তা মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেখানে এই অসুখের মধ্যে বিপ্লবের বীজ খোঁজা হয়েছে। যেন নাচের মধ্যে দিয়েই ঝরে পড়েছে প্রতিবাদ। নাচতে নাচতে কেউ অর্ধনগ্ন হয়ে পড়ছেন। কেউ আবার সম্পূর্ণ নিরাবরণ। তবু নাচ চলছে! দারিদ্র, গৃহহীনতা, পিতৃতন্ত্রের কঠোরতার বিরুদ্ধে এক অন্যরকম সপাট বিদ্রোহ। এভাবেই শিল্পীর কল্পনা যেন ইতিহাসকে নতুন করে চিনতে শেখায়, ভাবতে শেখায়।
ছোঁয়াচে অসুখ, মহামারী মানবসভ্যতা কম দেখেনি। এই মুহূর্তেও তো আমরা রয়েছি অতিমারীর মধ্যেই। তবু ‘ডান্সিং প্লেগ’-এর অভিনবত্ব তাকে এক স্বতন্ত্র অধ্যায় করে রেখেছে। কয়েকশো বছর পেরিয়ে এলেও যাকে ঘিরে বিস্ময়ের জলছাপ একই রকমের জ্বলজ্বলে হয়ে আছে।