ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: এক যুগ ধরে অসংখ্য এমন প্রতিবেদন লেখার সুবাদে অভিজ্ঞতা যা হয়েছে একটি সংস্থার কিছু গবেষণাধর্মী কাজের মধ্য দিয়ে তাদের বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। এবার আমি তাদের প্রথম এই ঘটনাটার কথা শোনাই। সাত বছর আগের একটা অ্যাকসিডেন্ট। তবে ঘটনাটা তাদের বলা ইস্তক খচখচ করছে একটা অস্বস্তি।
গুজরাটের সুরাটের ঘটনা। এক বন্ধু মারফত ব্যাপারটা সামনে আসে। সেই বন্ধুর পাড়ার এক পরিচিতের জীবনের ঘটনা। সুরাটের একটি সংস্থায় চাকরি করত সে। আদতে পাটুলির বাসিন্দা। বিয়ের পর সে স্ত্রীকেও নিয়ে যায়। সেখানেই আরও এক বাঙালি দম্পতির সঙ্গে আলাপ। একই কমপ্লেক্সে মুখোমুখি ফ্ল্যাট। দুই বাঙালির দোস্তি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, সংসার খরচটাই কার্যত তারা ভাগাভাগি করে চালাতে থাকে। একটি পরিবার সিনেমা দেখতে চাইলে দ্বিতীয়টিকেও সঙ্গে নেবে। আরেক পরিবার লং ড্রাইভে গেলে অন্যটিকেও তুলে নেবে। কিন্তু বছর সাতেক কেটে গিয়েছে, সেই দুর্ঘটনার পর সুরাটের সেই ফ্ল্যাট, চাকরি ছেড়ে পাটুলির সেই দম্পতি ফের সপরিবার কলকাতায়। কিন্তু সব ছেড়ে দিলেও লং ড্রাইভের সঙ্গী সেই গাড়ি তারা ছাড়তে পারেনি। কিন্তু সেই গাড়ি নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতেও পারে না তারা। সেই দম্পতির সঙ্গে সেই গাড়ি আপাতত কলকাতাতেই। পরিবারে এখন তাদের আরেকটি সদস্য, একটি বাদামি ল্যাব। ‘স্পিরিট’! সিস্টেম্যাটিক প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন, রিসার্চ অ্যান্ড ইনটেলিজেন্স টিম– সংক্ষেপে স্পিরিট। এই সংস্থাটির মাধ্যমেই এতদিন এই ধরনের ঘটনার বিশ্লেষণ সামনে এসেছে।
মূল গল্পে আসি। পাটুলির এই মেয়েটির সেই বান্ধবীর মৃত্যু হয় আচমকা এক দুর্ঘটনায়। সুরাটেই। তার পর থেকে যা যা ঘটেছে সেসব ঘটনা ধরে ধরে ‘স্পিরিট’-এর অন্যতম পদাধিকারী সৌমেন রায়ের বিশ্লেষণ, ঘটনাটি ‘প্যারানরমাল’ বা অপার্থিব ঘটনার জোরালো দৃষ্টান্ত। সঙ্গে এমন আরও ঘটনার কথা বলতে গিয়েই তিনি জানিয়েছেন, কখনও-সখনও সেই সব জগতের ‘পোর্টাল’-এর মুখ খুলে যায় মানবজগতের দিকে। তখনই তাদের স্পর্শ এসে লাগে, তাদের উপস্থিতি বুঝতে পারি। পাটুলির ভিতরের দিকে তিনতলায় সেই দম্পতির একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট। কলকাতায় তারা ফিরেছে প্রায় ছয় বছর। তার পর থেকে ফ্ল্যাট বদলে বদলে আপাতত এখানে। যার মারফত এই ঘটনা জানা, সেদিন সে বন্ধুর ফ্ল্যাটে গিয়েছে আড্ডা দিতে। আড্ডার মাঝেই আচমকা সেই ল্যাবটার চিৎকারে সব খানখান। ল্যাবটা ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে বাইরের অন্ধকারের দিকে ঘোলাটে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে চেঁচিয়ে চলেছে। ল্যাবটার বয়স পাঁচ। এই দম্পতির সঙ্গী হওয়ার পর থেকেই এমন থেকে থেকে সে চেঁচিয়ে ওঠে। যত দিন গিয়েছে, সে যেন বুঝিয়ে দিয়েছে এই পরিবারের কোনও ক্ষতি সে হতে দেবে না।
এবার মুখ খোলে ফ্ল্যাটের মালিক। বছর সাতেক আগের এক দুপুর। সুরাটের সেই মুখোমুখি ফ্ল্যাটে দুই বান্ধবী। রোজকার মতো কাজে বেরিয়ে গিয়েছে তাদের দুজনেরই স্বামী। কয়েকমাস হল সামনের ঘরের মেয়েটি গাড়ি চালানো শিখছে। ফাঁকা বেকার দুপুর, হঠাৎ তার ইচ্ছা হল গাড়ি নিয়ে বেরোবে হাত পাকাতে। সামনের ঘরে বন্ধুকে ডাকে, ‘যাবি?’ তার চোখে তখন ঘুম। একাই বেরোয় বন্ধু। শহরতলিতে সে মন্দ গাড়ি চালায় না। আস্তে আস্তে হাইওয়েতেও হাত পাকাতে হবে। বুক দুরদুর করতে করতে গাড়ি নিয়ে হাইওয়ে। বেশ চলছে গাড়ি। পাস দিয়ে হুশহাশ দু-একটা লরি চলে যাচ্ছে। স্বামীকে বারবার সে বলেছিল সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি না নিতে। মাঝেমাঝেই একটা খুটখুট শব্দ হয় ইঞ্জিনে। একটা ধাবা পেরিয়ে ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়িটি থামায়। ধাবা থেকে পেটপুজো সেরে তখন পরপর লরিগুলো নিয়ে বেরোচ্ছে চালকরা। বিকেল গড়াচ্ছে। ফিরতে হবে। তার আগে ইঞ্জিনে চোখ বোলালে হয় না? চালকের আসন ছেড়ে হাইওয়ের ধারে ডান দিকেই নেমে পড়ে মেয়েটি।
কাট টু বান্ধবীর ফ্ল্যাট। ডোরবেল বাজছে অনবরত, দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেখে পুলিশ। একটা হাতব্যাগ দেখিয়ে জানতে চায় চেনা কি না? চেনাই তো, সামনের ফ্ল্যাটের সেই বান্ধবীরই। কিন্তু পুলিশের হাতে কেন? সমস্ত প্রশ্ন, আশঙ্কা নিয়ে থানায় পৌঁছে জানতে পারে বান্ধবীর মৃত্যুর খবর। সেখান থেকে মর্গ। ততক্ষণে তার স্বামী ও বান্ধবীর স্বামীও পৌঁছে গিয়েছে। দেহ শনাক্ত করতে হবে। ওই হাতব্যাগ, হাতের আংটি ছাড়া দেহ চেনার আর উপায় তেমন নেই। একটা লরি মেয়েটির গাড়ির সঙ্গেই পিষে দিয়ে গিয়েছে শরীরটা। মাস দুয়েক পর সুরাটের সেই ফ্ল্যাটে একবার মাত্র ফিরেছিল পাটুলির দম্পতি। সেদিনই সন্ধ্যার ঘটনা। তাদের ঘরের আলো নিভে গেল, আচমকাই। বারবার এক জিনিস, মিস্ত্রি বারবার আসে। খুঁজে কিছুই মেলে না। মাঝেমাঝেই আবার ডোরবেল বেজে ওঠে। অথচ দরজার বাইরে কেউ নেই। ঘটনাটা মেয়েটি একা থাকলেই বেশি হয়।
ঠিক হয়, কলকাতা থেকে মেয়েটির আত্মীয়রা যাবেন। কদিন থেকে আসবেন সেখানে। মেয়েটিও একটু মেতে থাকতে পারে তাতে। যে গাড়িতে দুই দম্পতি লং ড্রাইভে যেত, সেটি নিয়েই বেরনো হল। শীতের বিকেল। লং ড্রাইভে গোটা পরিবার। শহর-শহরতলি ছাড়িয়ে একটু গাঁ-গঞ্জের দিকে ঢুকেছে গাড়ি। হঠাৎ গাড়ির ডোর সেন্সর জানাল ‘পিছনের বাঁদিকের দরজা খোলা’!
গাড়ি থামিয়ে সব পরীক্ষা করে ফের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আবার সেই ডোর সেন্সর, ‘পিছনের বাঁদিকের দরজা খোলা’। ভুলই হবে হয়তো ভেবে হাতে করে সবকটা দরজার লক পরীক্ষা হল, তার পরও দরজা খোলা! মনে আছে, শেষ যেবার বেরনো হয়েছিল, সেবার দুই দম্পতি একসঙ্গে বেরিয়েছিল। দুই স্বামী গাড়ির সামনে, আর বান্ধবী দুই স্ত্রী পিছনের আসনে। দুর্ঘটনায় যার মৃত্যু হয়, সে বসে ছিল সেই পিছনের বাঁদিকের আসনে। ঠিক এখন সেখানে বসে তারই বান্ধবীর বোন। ‘স্পিরিট’ জানাচ্ছে, এই পৃথিবীতে আরেক জগতের উপস্থিতি ঠিক এমনই, একেবারে গায়ে গায়ে।