shono
Advertisement

সত্যিই কি খ্রিস্টান সম্রাটের নির্দেশে নিষিদ্ধ হয়েছিল Olympics? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে

প্রচলিত সত্যের আড়ালে লুকিয়ে কোন সত্য?
Posted: 07:01 PM Aug 06, 2021Updated: 07:03 PM Aug 06, 2021

বিশ্বদীপ দে: প্রতীক্ষার প্রহর শেষে ফিরে ফিরে আসে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। ২০২১ সালের অলিম্পিক (Tokyo Olympics) শেষ হয়ে যাবে রবিবার। আবার শুরু হবে অপেক্ষার দিন গোনা। ২ বছর অন্তরই আয়োজিত হয় এই মহা প্রতিযোগিতার আসর। শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের (Olympics) জন্য মুখিয়ে থাকেন সারা বিশ্বের ক্রীড়ামোদীরা। ফুটবল বিশ্বকাপ কিংবা আরও কত খেলার আসরই তো রয়েছে। কিন্তু তবুও অলিম্পিকই ‘গ্রেটেস্ট’। এর পিছনে অবশ্যই অন্যতম ফ্যাক্টর দীর্ঘ ইতিহাসের সোনালি ঐতিহ্যের জলছাপ।
সেই কবে ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের (Greece) অলিম্পিয়ায় শুরু হয়েছিল অলিম্পিকের ক্রীড়াযজ্ঞ। যদিও ৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে এসে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় অলিম্পিক।

Advertisement

প্রায় হাজার বছরের ঐতিহ্য হঠাৎই থমকে দাঁড়ায়। এরপর বহু শতাব্দী পেরিয়ে কীভাবে ফের শুরু হয়েছিল আধুনিক অলিম্পিকের আসর, তা তো সকলেরই কমবেশি জানা। কিন্তু যে প্রশ্ন ফিরে ফিরে আসে তা অন্য। রোমান (Roman) সম্রাট থিওডোসিয়াস কেন নিষিদ্ধ করেছিলেন অলিম্পিককে? তিনি কি সত্যিই অলিম্পিককে নিষিদ্ধ করেছিলেন? নাকি ইতিহাসের আড়ালে রয়েছে অন্য কোনও লুকনো সত্যের হদিশ?

গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ

[আরও পড়ুন: Tokyo Olympics: সোনা জয়ের স্বপ্নে ইতি, শেষ চারে হার বজরং পুনিয়ার, খেলবেন ব্রোঞ্জের জন্য]

এখনও পর্যন্ত থিওডোসিয়াসের নির্দেশে অলিম্পিক নিষিদ্ধ হওয়ার কাহিনিই বহুল প্রচলিত। কিন্তু এমন কিছু প্রমাণ রয়েছে, যা সেই তত্ত্বকে অস্বীকার করে অন্য সত্যের খোঁজ দেয়। তবে সেকথা বলার আগে থিওডোসিয়াসের আমলে ফেরা যাক। আসলে অলিম্পিক ছিল এমন এক ক্রীড়াযজ্ঞ যার সঙ্গে নিবিড় যোগ ছিল গ্রিক দেবতা জিউসের। জিউস ছাড়াও পৌরাণিক বীর পিলোপ্সকে সম্মান প্রদর্শন করা হত প্রাচীন অলিম্পিকে। ধর্মীয় আচার ও রীতির এই সংস্পর্শের মধ্যেই পৌত্তলিকতার দেখা পেয়েছিলেন খ্রিস্টান ধর্মের ধারক ও বাহক রোমান সম্রাট থিওডোসিয়াস। ৩৯১-৩৯২ সাল নাগাদ পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে জারি করা তাঁর একগুচ্ছ আদেশ ‘থিওডোসিয়ান কোড’ নামে পরিচিত। সেখানে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, কোনও দেবতার উদ্দেশে কোনও কিছুকেই বলি হিসেবে পেশ করা যাবে না। যেমন জিউসের মূর্তির সামনে আলো জ্বালানো কিংবা কোনও পানীয় নিবেদন করা। মনে করা হয় না, সেই আদেশ মেনেই অলিম্পিকের উপরে নেমে আসে যবনিকা।

কিন্তু ‘থিওডোসিয়ান কোড’-এর কোনও অংশেই দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত অলিম্পিকের আসর সংক্রান্ত কোনও নির্দেশই ছিল না। ইতিহাসবিদ ইঙ্গমার ওয়েলার তাঁর লেখায় এমনই দাবি করেছেন। সেই সঙ্গে আরও অনেক প্রমাণ মিলেছে যা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়েও কিন্তু অলিম্পিয়ায় প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন ক্রীড়াবিদরা। সম্প্রতি আবিষ্কৃত সেই সময়ের এক শিলালিপিতে দেখা গিয়েছে বিজয়ী ক্রীড়াবিদদের নামের তালিকা। আসলে প্রাচীন যুগে বরাবরই অলিম্পিকে নামার ক্ষেত্রে ক্রীড়াবিদদের প্রধান লক্ষ্য থাকত দু’টো। একটি নিজের শহরকে গৌরবান্বিত করা। দ্বিতীয়টি, নিজের ক্যারিশমা বাড়িয়ে তোলা। যার অন্যতম চিহ্ন পাথরের গায়ে স্থায়ী নামাঙ্কন। থিওডোসিয়াসের আমলেও সেই বন্দোবস্ত থেকে কিন্তু বোঝা যায়, মোটেই তখন প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়নি। এখানেই শেষ নয়। কবি ক্লডিয়ানের লেখা থেকেও জানা যায় ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দেও চালু ছিল অলিম্পিক। ততদিনে মারা গিয়েছেন থিওডোসিয়াস। অর্থাৎ তাঁর জীবদ্দশায় অলিম্পিক নিষিদ্ধ হওয়ার ‘থিয়োরি’ ঠিক নয়।

রোমান সম্রাট থিওডোসিয়াস

[আরও পড়ুন: মেজর ধ্যানচাঁদের নামে খেলরত্ন পুরস্কার, রাজীব গান্ধীকে ছাঁটলেন PM Modi]

অলিম্পিক নিষিদ্ধ হওয়ার আরও একটি দাবি রয়েছে। সেটা থিওডোসিয়াসের নাতি দ্বিতীয় থিওডোসিয়াসের আমল। ৪০৮ থেকে ৪৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সম্রাট। পঞ্চম শতাব্দীতে তাঁর নির্দেশেই বন্ধ করে দেওয়া হয় অলিম্পিক। এক অজ্ঞাতনামা লেখকের লেখায় এর উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ”অলিম্পিয়ায় জিউসের মন্দিরে আগুন লাগার পর এলিয়ান উৎসব ও অলিম্পিক দু’টোই বন্ধ করে দেওয়া হয়।”

কিন্তু এই দাবিও সম্ভবত ঠিক নয়। অলিম্পিক পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এরপরও। তবে অলিম্পিয়ায় সম্ভবত আর সেই খেলার আসর বসেনি। ৪২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরেক প্রাচীন শহর এফেসাসে শুরু হয় একই রকম প্রতিযোগিতা। পরবর্তী সময়ে তা ছড়িয়ে যায় সিরিয়ায়। একথা ঠিকই খ্রিস্টীয় যাজকরা বরাবরই অলিম্পিকের মতো আসরের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত ছিলেন। তবুও পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেই সময়ের এক খ্যাতিমান পুরুষ রোমান সেনেটের সদস্য লিওন্তিওস নিজের উদ্যোগে একটি অলিম্পিকের আয়োজন করেছিলেন। সেই খ্রিস্টীয় সেনেটর কি এমনটা করতে পারতেন যদি এই ধরনের ক্রীড়াযজ্ঞের আয়োজন সেই সময় তীব্র ভাবে নিষিদ্ধ থাকত?

শিল্পীর কল্পনায় প্রাচীন অলিম্পিক

এই সমস্ত তথ্যপ্রমাণ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, খ্রিস্টীয় ধর্মমতের সঙ্গে পৌত্তলিকতার লড়াইয়ের ধাক্কায় অলিম্পিকের উপরে নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে আসার দাবি ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু তাহলে কেন পঞ্চম শতাব্দীতে অলিম্পিয়া থেকে অলিম্পিকের আসর বন্ধ হয়ে গেল? প্রাচীন সেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকে যা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মিলেছে তা থেকে এর আঁচ মেলে। জিউসের মূর্তি যা কিনা সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম হিসেবে ধরা হত, তাকে সেই সময়ই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কনস্ট্যান্টিনোপলে। ফলে বোঝা যায়, অলিম্পিয়া অলিম্পিক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল।

ইতিহাসবিদ সোফির মতে, পৌত্তলিকতার বিরোধিতার সঙ্গে অলিম্পিক বন্ধ হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে সরাসরি যোগ রয়েছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির। আসলে চতুর্থ শতাব্দী থেকেই মূলত ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হত অলিম্পিক। রাজকোষ থেকে যে সাহায্য মিলত তা লাগানো হত অন্য কাজে। অলিম্পিয়ার প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পিছনে আসল কারণ ছিল ধনী পৃষ্ঠপোষকের অভাব। কিন্তু সেই সত্যিকে আড়ালে রেখে পৌত্তলিকতা বনাম খ্রিস্টীয় সংঘাতের কাহিনিই জনমানসে ছড়িয়ে পড়েছে। যা থেকে প্রমাণ হয়ে যায় ইতিহাসের আড়ালে থাকা সত্য একদিন তার নিজের জোরে বেরিয়ে আসবেই। অলিম্পিকের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়াযজ্ঞের সুপ্রাচীন ইতিহাসেও তার অন্যথা হয়নি।

আজও ইতিহাস থমকে আছে অলিম্পিয়ায়
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement