বোরিয়া মজুমদার: গেম স্পিরিটের শেষ কোথায়, আর কোথায়ই বা নিয়মনীতির শুরু? ক্রিকেট কি কখনও “জেন্টলম্যান’স গেম” ছিল? লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাতের কথা বলছি না, প্রশ্ন করছি, এই খেলায় কি কখনও নৈতিকতা বা নীতিশাস্ত্রের একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠি ছিল, যা ক্রিকেটীয় নিয়মের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে? স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে, এই ‘ভদ্রজনোচিত’ তকমাটি কেবলমাত্র একটি নির্মাণ ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রথমেই শুরু করি ডব্লিউ. জি. গ্রেসের প্রসঙ্গ দিয়ে, যিনি সর্বজনীনভাবে ক্রিকেটের জনক হিসাবে স্বীকৃত। তিনি প্রথম বলে আউট হয়ে যাওয়ার ঘটনায় আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, মাঠে মানুষ তাঁকে ব্যাট করতে দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছেন, প্রথম বলে আম্পায়ারের এই সিদ্ধান্ত দেখার জন্য নয়। তিনিই বলপূর্বক ট্রায়াল বলের নিয়মের প্রবর্তন করেন। ক্রিকেট-যুক্তি মানলে বলতে হয়, গ্রেস অন-ফিল্ড আম্পায়ারের সঙ্গে তর্ক করেন ক্রিকেটের নিয়ম, অনুশাসন না মেনেই। গ্রেস ছিলেন আদ্যোপান্ত পেশাদার, ক্রিকেট-দক্ষতার দৌলতে তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এটা কি তাঁর কাজকে ‘অনৈতিক’ বলে প্রতিপন্ন করে এবং তাঁকে অসম্মানের ভাগীদার করে তোলে? একেবারেই নয়।
ক্রিকেটের অন্যতম বিতর্কিত সিরিজ ‘বডিলাইন’ প্রসঙ্গে বলি। জার্ডিন যদি ক্রিকেটীয় স্পিরিট কঠোরভাবে মেনে চলতেন, তাহলে এই সিরিজ কোনও দিন বাস্তবায়িত হত না। তিনি জানতেন যে, ব্র্যাডম্যানকে রুখতেই হবে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লারউড, যিনি খেলার নিয়মের মধ্যে থেকেও অপ্রতিরোধ্য ব্রাডম্যানকে থামানোর একটি উপায় বের করেছিলেন। সত্যি বলতে কী, তাঁর কাছে দু’টি পথ ছিল- এক, হার মেনে নেওয়া, অথবা প্রাণপণ লড়াই করে জেতার চেষ্টা। তিনি পরবর্তীটি বেছে নিয়েছিলেন। এর চেয়ে উপযুক্ত কাজ আর কীই-বা হতে পারত? হেরে যাওয়ার জন্য কেউ মাঠে নামে না, কারণ তাতে বহু বছরের কঠোর পরিশ্রম যেমন ব্যর্থ হয়, তেমনই ভক্ত অনুরাগীরা হতাশ হয়ে পড়ে। যতক্ষণ কেউ প্রশাসক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের মধ্যে থেকেই নিজের কাজ করেন, ততক্ষণ তা তাঁর অপরাধ নয়।
[আরও পড়ুন: মাদক না নিলে কি তারকা হওয়া যায় না?]
‘ম্যানক্যাডিং’ ইস্যুতে এম. এস. ধোনির ঘটনাটাই উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক। ২০১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মাত্র ২ ইঞ্চির ব্যবধানে রানআউট হয়ে গেলেন তিনি। যদি সেদিন তিনি ক্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করতেন, সম্ভবত তিনি রান পেতেন। এখন প্রশ্ন হল, একজন ব্যাটার যদি তাঁর ক্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে আইন ভঙ্গ করেন, তাকে অন্যায় সুবিধা হিসাবে গণ্য করা হবে না, কিন্তু যদি বোলার তাঁকে তা করতে বাধা দেন, সেক্ষেত্রে বোলার একা অনৈতিক? ব্যাটারও একই দোষে দোষী নন কেন? আদতে ব্যাটারই আইন ভঙ্গ করছেন। বোলার কেবল তাঁকে তা করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছেন। বোলারের এই চেষ্টাকে কোনওভাবেই ‘অপরাধ’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে কাঠগড়ায় তোলা যায় না।
‘ওয়াক আউট’ সম্পর্কে প্রায়শই আলোচ্য একটি বিষয়ে আসছি। ২০০৩ সালের ওয়ার্ল্ড কাপের সেমিফাইনাল ম্যাচে আম্পায়ারের ‘নট আউট’ সিদ্ধান্তের পরও অ্যাডাম গিলক্রিস্টের স্বেচ্ছায় ‘ওয়াক আউট’ অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কিন্তু এমন নয় যে, তিনি বহুবার এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন। এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে, যখন তিনি ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ তখন তাঁর কাছে জয় অগ্রাধিকার পেয়েছিল। আমাদের কি এক্ষেত্রে তাঁকে নীতিহীন গণ্য করে গিলক্রিস্টকে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত? নিশ্চয়ই নয়। কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে তাঁর উপর নির্ভর করে যে, তিনি ‘ওয়াক আউট’ করবেন কি না। কিন্তু যদি তিনি অন্যদের উপর ‘ওয়াক আউট’ চাপিয়ে দিতেন, তাহলে তা হত স্পষ্টতই নিয়মভঙ্গের ঘটনা।
এই প্রসঙ্গ ধরেই আমি অশ্বিনের কথা তুলব। অশ্বিন যা করলেন, তা কি তাঁর এক্তিয়ারভুক্ত? মরগ্যান যেভাবে তাঁকে অমর্যাদা করলেন, তা কি তাঁর প্রাপ্য? এখানে আমাদের স্পষ্ট করে জানতে হবে, অশ্বিনের এ-বিষয়ে কী বলার আছে। তিনি কি আদৌ কোনও ভুল করেছেন? আমি স্পষ্ট করে জানাই, অশ্বিন খেলার নিয়ম লঙ্ঘন করেননি। খেলায় বিশেষ কিছু নিয়ম প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। যা আসলে একটি প্রশাসনিক টেমপ্লেট- প্রশাসকরা খেলাটি পরিচালনা করার জন্য যা ব্যবহার করেন। বিধি মেনে চলা যেমন অশ্বিনের কর্তব্য, তেমনই তিনি নিয়মভঙ্গ করলে অন-ফিল্ড আম্পায়াররা হস্তক্ষেপ করে তাঁকে সঠিক পথে চালনা করতেও পারতেন। একজন ক্রীড়াবিদ হিসাবে তাঁর কাজ নিয়ম মেনে খেলার চেষ্টা করা ও জয়লাভ করা। তিনি ঠিক তাই করেছিলেন। যদি কেউ আইন-নির্মাতাদের দ্বারা সংজ্ঞায়িত খেলাধুলোর কাঠামো মেনে কাজ করেন, সেক্ষেত্রে তাঁকে অপমান অথবা অমর্যাদার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বরং অশ্বিনকে এমন একটি কাজের জন্য ভর্ৎসনা করা হল, যা তিনি করেননি। এটি করে মরগ্যান হয়তো ভুল করলেন বা নিজের সীমা ছাড়িয়ে গেলেন। অনেকেই বলছেন, ২০১৯ সালে বেন স্টোকসের ঘটনার সঙ্গে অশ্বিনের এই ঘটনার তুলনা চলে না। সত্যি বলতে, প্রশ্নই নেই।
[আরও পড়ুন: অবসরের নির্দিষ্ট বয়স নেই, ক্ষমতা হস্তান্তরই বড় চ্যালেঞ্জ ভারতীয় রাজনীতিতে]
আমরা কতবার দেখেছি মরগ্যানকে স্টোকসের বাউন্ডারির জন্য ক্ষমা চাইতে? তিনি কি তাঁর বিবেকের উপর সেই বাউন্ডারির নৈতিক বোঝা বহন করছেন? যা ঘটেছে, তার জন্য তিনি কি দুঃখিত? তিনি কি জানেন, তাঁর এই কাজের খেসারত দিতে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে হল একটি বিশ্ব-শিরোপা? যদিও আমরা সবাই জানি, স্টোকস বল বাউন্ডারির দিকে ঘোরানোর পর বেশি কিছু করতে পারেননি, কিন্তু প্রশ্ন হল, ইংল্যান্ড কি মাঠে থাকা আম্পায়ারদের সঙ্গে কথা বলে কিছু সুরাহা করতে পেরেছিল? তারা কি তাদের রান নিয়ে খুশি ছিল, তা সে যে পথেই আসুক না কেন? কতটা উল্লসিত ছিল তারা? তারা কি এক মুহূর্তের জন্যও ভেবেছিল, এটি খেলার আইনের মধ্যে পড়ে না? যখন তারা ক্রিকেটের মক্কায় বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেছিল, তখন কি তারা অপরাধবোধে ভুগছিল? তাদের কি মনে হচ্ছিল যে, তারা শুধুমাত্র ভাগ্যের জোরে বিশ্বকাপ জিতে গিয়েছে?
সত্যি বলতে, খেলাধুলোয় এমন কথা ভাবাও হাস্যকর। ইংল্যান্ড ন্যায্য এবং সৎভাবেই বিশ্বকাপ জিতেছিল। তারা বেআইনি কিছু করেনি। তারা ভাগ্যবান এবং অন্যদের না পারার দায় তাদের নয়। বেন স্টোকস যা করেছিলেন, তার জন্য তাঁর মর্যাদাহানি হয়নি। অশ্বিনেরও হবে না। খেলাধুলায় এমন শত শত উদাহরণ রয়েছে, যখন একজন পারফরমার একটি নির্দিষ্ট নিয়মের সুবিধা নিয়েছেন। নিয়মটি পরে পরিবর্তনও করা হয়েছে, যখন নিয়ম-নির্ধারকরা বুঝতে পেরেছেন যে, তাঁরা সঠিক ছিলেন না। কিন্তু যে সময়ে আইনটি বহাল ছিল, পারফর্মাররা সেই সুযোগ নিয়েছেন এবং অনেক সময়ই তাতে খেলার ফলাফল প্রভাবিত হয়েছে। অশ্বিনের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। যদি আইসিসি এই নিয়ম পরিবর্তন না করে, তবে অশ্বিন এই কাজ ভবিষ্যতেও করবেন। কারণ তা করার অধিকার তাঁর রয়েছে। কোনও মরগ্যান, কোনও ওয়ার্ন তাঁকে থামাতে পারবেন না। প্রকৃতপক্ষে যদি কেউ তাঁকে নিয়মের মধ্যে খেলার জন্য ‘কলঙ্ক’ বলে অভিহিত করে, তা তাঁদের রুচির প্রতিফলন। আশা করি, এই বিতর্কের ইতি হবে। এবং নিয়ম ও কেবলমাত্র নিয়মই খেলাধুলোয় চূড়ান্ত হিসাবে বিবেচিত ও গৃহীত হবে।